হামাস ও ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতিতে কি রাজি করাতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র

0

গাজায় ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কখনো সহজ কাজ নয়। কয়েক সপ্তাহের আলোচনার পর কোনও সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমশ বাড়ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের তরফে কায়রোতে সর্বশেষ দফার আলোচনায় সিআইএ প্রধান উইলিয়াম বার্নসকে পাঠানোর মতো পদক্ষেপই সম্ভবত এর সবচাইতে বড় ইঙ্গিত।

একদিকে হামাস তাদের প্রাথমিক দাবি দাওয়াতেই অনড় রয়েছে, অন্তত প্রকাশ্যে তারা তাই জানিয়েছে। এই দাবি দাওয়াগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, ইসরায়েলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং কোনও বাধা ছাড়াই বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের উত্তরাঞ্চলে ফিরিয়ে আনা। আর অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, হামাস ধ্বংস এবং তাদের (হামাসের) হেফাজতে থেকে জিম্মি মুক্ত না করা পর্যন্ত ইসরায়েল লড়াই চালিয়ে যাবে।

তার মানে কিন্তু এটা নয় যে চুক্তির বিষয়টা এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ইসরায়েলের কর্মকর্তারা কিছু বিষয়ে ছাড় দেওয়ার কথা বলেছেন বটে কিন্তু তার পিছনে রয়েছে তাদের মিত্র দেশগুলির মধ্যে বাড়তে থাকা হতাশা। সেই তালিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রয়েছে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছিলেন, যুদ্ধবিরতির জন্য ‘সঠিক সময় এটাই’।

এই সমঝোতা হতে পারে কয়েকটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে। তার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তির বিনিময়ে হামাসের হামলার সময় আটক করা জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়টা। নভেম্বরে সাময়িক যুদ্ধবিরতির ভিত্তিও এটাই ছিল।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের মতে, গাজায় ১৩৩ জন জিম্মি রয়েছে, যদিও এদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে ইতিমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রস্তাব অনুযায়ী, ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির প্রাথমিক পর্যায়ে হামাস ৪০ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দেবে। মুক্তির ক্ষেত্রে নারী বন্দি, ৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ এবং গুরুতর অসুস্থ ও সেনাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

অন্যদিকে, ইসরায়েল মুক্তি দেবে কমপক্ষে ৭০০ ফিলিস্তিনিকে। এদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন ইসরায়েলিদের হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন, যা অতীতে ইসরায়েলে বিতর্কিত বলে প্রমাণিত হয়েছিল। তবে হামাস মধ্যস্থতাকারীদের জানিয়েছে যে ৪০ জন জিম্মির কথা বলা হয়েছে তারা তাদের কাছে নেই। হামাসের এই দাবি একাধিক আশঙ্কাকে উস্কে দিয়েছে।

যত সংখ্যক জিম্মি মারা গিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে প্রকৃত সংখ্যা তার চাইতে অনেক বেশি হতে পারে। জিম্মিরা ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের মতো অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে রয়েছে এমন সম্ভাবনাকেও বাড়িয়ে তুলেছে হামাসের এই দাবি।

এদিকে, ইসরায়েলে সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন অংশের চাপের কারণে নেতানিয়াহুর কৌশলের জায়গা সীমিত হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের বেশিরভাগ মানুষ যুদ্ধের সমর্থন করলেও জিম্মিদের মুক্তির জন্য চুক্তিতে সম্মত হতে ক্রমাগত বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে আহ্বান জানানো হচ্ছে।

বন্দিদের ফেরানোর অগ্রাধিকার না দেওয়া এবং প্রধানমন্ত্রী নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন- এই অভিযোগ জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ব্যাপক বিক্ষোভও দেখিয়েছে। একইসঙ্গে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিও জোরালো হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ক্ষমতাসীন জোটে বিভাজন দেখা গিয়েছে। এই জোটে রয়েছে উগ্র ডানপন্থী, অতিজাতীয়তাবাদী মিত্ররা, যারা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে এবং হামাসকে কোনও রকম ছাড় দিতে তারা নারাজ। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন হামাসের উপর ক্রমবর্ধমান চাপই জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা এবং গোষ্ঠীটিকে ধ্বংস করার একমাত্র উপায়। অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দক্ষিণ গাজার রাফাহতে আক্রমণ না করা হলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গদিচ্যুত করা হবে।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন রাফাহতে প্রবেশ করাটা অপরিহার্য কারণ হামাসের চারটে অপারেশনাল ব্রিগেড এবং এর প্রবীণ নেতারা সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারেন। তবে বেসামরিক নাগরিকদের উপর এর প্রভাবের আশঙ্কায় ইসরায়েলের ছাড়া সবাই এই অভিযানের বিরুদ্ধে। কারণ প্রায় ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি সেখানে তাঁবু, আশ্রয়কেন্দ্র ও জনাকীর্ণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে।

সোমবার প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অবশ্য জানিয়েছেন রাফাহ অভিযানের জন্য ইতোমধ্যে একটা তারিখ স্থির করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সমালোচনা মোকাবিলা করতেই তার এই মন্তব্য বলে অনেকেই মনে করেন। গেরশন বাসকিন বলেন, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে সরকারে এবং লিকুদ-এর (নেতিনিয়াহুর দল) অভ্যন্তরে এখন বিদ্রোহ চলছে সেই সমস্ত চুক্তিকে ঘিরে যা তাদের চূড়ান্ত করা উচিৎ নয়।

তিনি বলেন, “তবে নেতানিয়াহু একা নন। নিজের সরকারের কাছে তিনি নিজেই জিম্মি।” সর্বশেষ প্রস্তাবের বিষয়ে হামাস এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে একথা জানিয়েছে যে তারা এমন চুক্তিতে আগ্রহী যা তাদের ‘জনগণের উপর আগ্রাসন বন্ধ করবে’ এবং এই প্রস্তাব তাদের দাবি পূরণ করেনি।’

এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, ‘ইসরায়েল এখনও নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছে।’ হামাসের এই বার্তা হোয়াইট হাউজের কাছে ‘তেমন উৎসাহব্যাঞ্জক নয়’ বলেই মনে হয়েছে। মনে করা হচ্ছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন গাজার হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার যিনি রক্ষী ও জিম্মিদের দ্বারা বেষ্টিত সুড়ঙ্গে লুকিয়ে আছেন। তার সাথে যোগাযোগ করা কঠিন। যোগাযোগের পথে রয়েছেন বেশ কয়েকজন মধ্যস্থতাকারী এবং কয়েক দিন সময় লাগে এই নেতা অব্দি খবর পৌঁছতে।

বাসকিন জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া বিষয়ে হামাসের আরও বক্তব্য রয়েছে। এর পাশাপাশি বন্দিদের অন্য দেশে নির্বাসনের শর্তে তারা রাজি হবে না বলে জানিয়েছে। এই বিষয়গুলো কোনও সমঝোতায় আসার ক্ষেত্রে সমস্যা ঘটাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

হামাস বিশ্বাস করে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির নিশ্চয়তা না থাকলে জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার পর ইসরায়েল তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাবে। হামাসের নেতৃত্ব ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক স্তরে ইসরায়েলের সমালোচনা হতে দেখেছে। হামাস মনে করে ‘সময় তাদের পক্ষে’ এবং এই সুযোগে সমঝোতার সময় তারা কোনও ছাড়ও পেয়ে যেতে পারে।

যদিও গাজায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে দ্রুত মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। সাতই অক্টোবর হামাস নেতৃত্বাধীন হামলায় প্রায় ১২০০ জন নিহত এবং ২৫০ জনেরও বেশি মানুষকে জিম্মি নেওয়া হয়েছিল। তার উত্তরে ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণ চালায়।

হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এর ফলে ৩৩ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলটির বিরাট অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এবং বহু ফিলিস্তিনি খাবারের দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে।

“আমার অভিজ্ঞতা বলছে এইসব ক্ষেত্রে এই বিষয়টা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী গোষ্ঠী বা দুই পক্ষ চুক্তি করতে রাজি কি না। এই বিষয়টা কিন্তু এখনও স্পষ্ট নয়,” বলেন বাসকিন।

“নেতানিয়াহু চুক্তির জন্য প্রস্তুত কি না তা স্পষ্ট নয়, এটাও স্পষ্ট নয় যে (গাজায় হামাসের রাজনৈতিক নেতা) ইয়াহিয়া সিনওয়ার চুক্তির জন্য তৈরি কি না। কিন্তু তারা রাজি হলেই ঠিক একটা মধ্যপন্থা খুঁজে নেবে।”

এই প্রসঙ্গে হামাসের এক মুখপাত্রের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। রাফাহ আক্রমণের তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মন্তব্যের সমালোচনা করে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, দিন যখন ঠিকই করা হয়েছে তা হলে চুক্তি প্রসঙ্গে আবার কথাবার্তা শুরু করার কোনও প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here