‘আটটা বাজে, দেরি করিস না’ এবং আরও কিছু কথা…

0

পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ সিনেমা কেবলমাত্র বাংলাদেশেই ঝড় তুলেছিল, তাই নয়। সীমান্ত পেরিয়ে ওপার বাংলাতেও (পশ্চিমবঙ্গ) সিনেমাপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছে এই ছবিটি। এমনকি দর্শকদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে গত বছরের শেষ দিকে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে সেই ছবির শো সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছিল। কেবলমাত্র অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীসহ অন্যান্য কলাকুশলীদের অভিনয়ই মন কাড়েনি, এই ছবির গানগুলোও মনে ধরেছিল মানুষের। 

যায় মধ্যে অন্যতম গানটি হল ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও নেট দুনিয়াতে ভাইরাল হওয়া সেই গানের সুরকার এবং গীতিকার মনিরুদ্দিন আহমেদ। অর্থাৎ তারই লেখা, তারই গাওয়া। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিউড়ি লালকুঠি গ্রামের বাসিন্দা মনিরুদ্দিন জানান, ১৯৮৬ সালে এই গানটি লেখা হয়। পরে সেই গানের ক্যাসেটও প্রকাশিত হয়। তাতেও তার নাম ছিল। কিন্তু তার আক্ষেপ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যে গানটি আজ জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছল, সেখানে কোথাও তার নামটুকু পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

মেজবাউর রহমান সুমন বলেন, ‘আমরা যে ইচ্ছাকৃতভাবে মনিরুদ্দিন আহমেদের নাম দেয়নি তা নয়। আমরা এই গানের গীতিকার ও সুরকারের নাম যে খুঁজিনি তাও নয়। আপনি অবাক হবেন জেনে যে আমরা বছরের পর বছর এই গানের গীতিকার-সুরকারকে খুঁজেছি। কিন্তু কেউই বলতে পারেননি। এমনকি বাসুদেব দাস বাউলসহ ওপার বাংলার যেসব শিল্পী গানটি গেয়েছেন তারাও মনিরুদ্দিন আহমেদের কথা জানতেন না। ছবি মুক্তির প্রায় দশ মাস পর এসে বিষয়টি পরিস্কার হয়েছে, আমরা গানটির প্রকৃত স্রষ্টাকে খুঁজে পেয়েছি।’

‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানের গীতিকার ও সুরকার হিসেবে মনিরুদ্দিন আহমেদকে রেমুনেরেশন দেওয়া হবে জানিয়ে ‘হাওয়া’র নির্মাতা আরও বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে যখন মনিরুদ্দিন আহমেদের দেখা করবো, তখন অবশ্যই তাকে গানটির গীতিকার ও সুরকার হিসেবে একটা রেমুনেরেশন দেওয়া হবে। এরই মধ্যে আমরা যোগাযোগ করেছি মনিরুদ্দিনের ছেলের সঙ্গে। আশা আছে সময় সুযোগ নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিউড়ি লালকুঠি গ্রামে মনিরুদ্দিনের বাড়িতে যাওয়ার।’

এদিকে, ৮১ বছর বয়সী মনিরুদ্দিন গানটির বিষয়ে আরও জানান, “১৯৮৬ সালে আমি এই গানটি লিখি। সেই গানটি হল ‘৩০ টাকা কেজি মাছ, বাবু ভেজে খাবে লো- আটটা বাজে দেরি করিস না।’ পরে দেখলাম এই গানটা বাংলাদেশের হাওয়া ছবিতে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থী এই গানটার সঙ্গে নাচছে, আমাদের রাজ্যেও বেশ কয়েকজন যুবককে এই গানটির সাথে নাচতে দেখা যায়। কিন্তু এটা যে আমার গান সেটা কেউ বলেনি বা পরিচয়ও দেয়নি।” 

তিনি আরো জানান, ‘গানটি লেখার পর আমিনুল রশিদ নামে আমাদের পাড়ার স্থানীয় এক বাসিন্দা আমি তাকে চাচা বলতাম তিনি মাঝেমধ্যে এই গানটা গাইতেন। তার বাড়িতে গানের আসর বসতো। আমিনুল রশিদ বাংলাদেশ বেতারে কাজ করতেন। মাঝে এই গানটার খুব একটা চর্চা ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই এই গানটা শোনা যাচ্ছে।’ 

বীরভূম জেলা পঞ্চায়েত অফিসের অ্যাকাউন্টস ও অডিট বিভাগে করণিক পদে কর্মরত ছিলেন মনিরুদ্দিন। তার দাবি, এই গানটি প্রথম ক্যাসেট করেন জিতেন নন্দী এবং কার্তিক দাস বাউল নামে দুই ভারতীয়। সেই ক্যাসেটে তার নাম দেওয়া হয়েছিল।’ 

কিন্তু হাওয়া সিনেমায় এই গানটি কিভাবে চলে গেল এবং সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘সেটা আমি জানি না। আমার ধারণা সিউড়ির কোন ব্যক্তি হয়তো জাহাজে কাজ করতো, তারা এই গানগুলো নিয়ে পালিয়েছে। আবার এটাও হতে পারে যে বীরভূম বা বোলপুরের কোন ব্যক্তি ওই গানটি নিয়ে জাহাজে সাপ্লাই করে দিয়েছে।’

শিল্পী চান তার নামটি যেন সিনেমার ক্রেডিট লিস্টে ব্যবহার করা হয়। প্রায় চার দশক আগে ডায়েরির পাতায় যে গান লেখা হয়েছিল- তাতে আজ হলুদ ভাব এসেছে। বৃদ্ধ মনিরুদ্দিন সেই ডায়েরির পাতা উল্টে বিভিন্ন সময়ে তার লেখা গান দেখালেন, গেয়ে শোনালেন সেই গানের কয়েকটা লাইনও। 

মনিরুদ্দিনের লেখা ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানটির কণ্ঠশিল্পী বীরভূমের বাসিন্দা বাসুদেব দাস বাউল। যদিও এই সিনেমার ক্রেডিট লিস্টে তার নাম দেওয়া হয়েছে। তবে সেসময় তিনিও এই গানটির সুরকার বা গীতিকারের নাম জানতেন না। ফলে গীতিকার ও সুরকারের জায়গায় ‘সংগৃহীত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সম্প্রতি এই বিষয়টি জানার পর মনিরুদ্দিনের সাথে ফোনে কথা বলেন বাসুদেব দাস বাউল। তার সাথে দেখাও করতে চাইছেন তিনি। 

এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার বাসুদেব দাস বাউল জানান, “আটটা বাজে দেরি করিস না’ এই গানটি খুব ভালো। সাংসারিক ঘটনার উপর লেখা। আমি ছোটোবেলা থেকেই এক গানটা করতাম। কিন্ত লেখক কে জানতাম না। পরে আমি মনিরুদ্দিনের সাথে ফোনে কথা বলি। তার বাসায় গিয়ে দেখা করে আসবো বলেও তাকে কথা দিয়েছি।” 

বাসুদেব আরো জানান, “হাওয়া’ মুভির পক্ষ থেকে আমাকে এই গানটার লেখকের নাম জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি বলতে পারিনি। তখন জানতাম না। এখন আমি তাদেরকে জানাতে চাই, যাতে মনিরুদ্দিন আহমেদের নামটা সবখানেই তুলে ধরা হয়।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here