লাশের গন্ধে ভারী মিয়ানমারের সাগাইংয়ের বাতাস

0

যখন পায়ের নিচের মাটি কাঁপছিল, সেই সময়ে ধসে পড়া ভবন, এবড়োথেবড়ো সড়ক ও গর্ত পেরিয়ে তার জন্মস্থান শহর সাগাইংয়ের দিকে আসছিলেন কো জেয়ার। গত ২৮ মার্চ মিয়ানমারে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার যে ব্যাপক শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটে, সেটির উৎপত্তিস্থল বা এপিসেন্টার ছিল মধ্যাঞ্চলীয় সাগাইং শহর।

মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয় থেকে সাগাইংকে পৃথক করেছে দেশটির অন্যতম বৃহৎ নদী ইরাবতী। সাধারণ সময়ে গাড়িতে ইরাবতী সেতুর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট, কিন্তু ভূমিকম্পের পর ইরাবতী নদী পেরোতে কো জেয়ারের সময় লেগেছিল ২৪ ঘণ্টা।

সাগাইংয়ে ফিরে জেয়ার জানতে পারেন, তার পরিবারের সদস্যরা এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও অনেক বন্ধু ও স্বজন প্রাণ হারিয়েছেন এই ভূমিকম্পে। বস্তুত, গত ২৮ মার্চ যে ভূমিকম্প হয়েছে, সেটিকে গত এক শতাব্দির মধ্যে মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প বলছেন ভূতত্ববিদরা। সাগাইং, রাজধানী ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়সহ বিভিন্ন শহরের ধ্বংস্তূপ থেকে এ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৫৪ জনের মৃতদেহ। উদ্ধারকারী বাহিনীর কর্মীরা জানিয়েছেন, এখনও অনেক মৃতদেহ ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়ে আছে বলে ধারণা করছেন তারা। সেই সংখ্যাটি কত হতে পারে তা এখনও ধারণা করা যাচ্ছে না।

পেশায় সমাজকর্মী কো জেয়ার সিএনএনকে বলেন, “লাশের গন্ধে সাগাইংয়ের বাতাস ভারী হয়ে আছে। ফের ভূমিকম্প হতে পারে এ  আশঙ্কায় কেউ ঘরে প্রবেশ করছে না, শহরের প্রায় সব বাসিন্দা ভূমিকম্পের পর থেকে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সড়কে, প্ল্যাটফর্মে, মাঠে, পার্কে থাকছে। আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরাও এ দলে আছি।”

জেয়ার জানান, গত পরশু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও একদফা আফটারশক অনুভব করেছেন তারা।

বাড়িঘরের পরিবর্তে খোলা আকাশের নিচে দিন-রাত কাটানোর ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকে রেহাই পেলেও অন্যান্য সংকটে জর্জরিত সাগাইংয়ের বাসিন্দারা। শহরে খাবার ও সুপেয় পানির যোগান অনিয়মিত, দিনের বেলায় অনেক সময় তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং তার সঙ্গে রয়েছে মশার বিরামহীন যন্ত্রণা।

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশ মিয়ানমার। তার ওপর গত চার বছর ধরে দেশজুড়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর অব্যাহত সংঘাত মিয়ানমারের অর্থনীতিকে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে। ভূমিকম্পের আগে মার্চ মাসের শুরুর দিকে জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, মিয়ানমারে প্রায় ২ কোটি মানুষের খাদ্য ও মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।

২০১৯ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেসামরিক সরকারকে উচ্ছেদ করে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং এ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের প্রধানও তিনি।

সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার প্রায় ৬ মাস পর থেকে সক্রিয় হয়ে ওঠে জান্তাবিরোধী বিভিন্ন সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দেশজুড়ে সংঘাত শুরু হয় তাদের এবং বর্তমানে মিয়ানমারের মোট ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য অংশ এই গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে।

এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আঁতাত রয়েছে মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী গণতান্ত্রিক দল ও শক্তিগুলোর জোট ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (নাগ)। নাগের অন্যতম নেতা কিয়াও মিন সিএনএনকে জানান, ভূমিকম্পের পর থেকে এ পর্যন্ত বেসামরিক উদ্ধারকারী বাহিনী, নাগ ও সাধারণ লোকজন উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। সামরিক বাহিনী এ তৎপরতা থেকে নিজেকে দূরে রাখছে।

কিয়াও মিন বলেন, “আমাদের কাছে ভারী যন্ত্রপাতি নেই, যেসব সাধারণ মানুষ উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিচ্ছেন, তাদের অনেকেরই এ বিষয়ক প্রশিক্ষণও নেই। তারপরও আমরা দিন-রাত কাজ করে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে পেরেছি।”

“সামরিক বাহিনীর কাছে ভারী যন্ত্র ও প্রশিক্ষণ— দুইই আছে। তারা যদি এগিয়ে আসত, তাহলে উদ্ধারকাজ আরও গতিশীল হতো।”

এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক সাবেক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি-ও। সিএনএনকে লি বলেন, “মিয়ানমারে যে মাত্রার বিপর্যয় ঘটেছে, মিন অং হ্লেইংয়ের উচিত ছিল উদ্ধার তৎপরতার জন্য সেনাবাহিনীর যাবতীয় সক্ষমতাকে প্রয়োগ করা। কেন এখনও তিনি তা করছেন না? কেন কেবল বেসামরিক লোকজনকে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে হচ্ছে? তার বাহিনীর কাজ কী আসলে?”

সূত্র: সিএনএন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here