দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন একটি আইন পাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খুব শিগগির আইনটি করা হবে। পাশাপাশি টাকা ফেরানোর ক্ষেত্রে সহায়তা নিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম থাকা ৩০টির মতো আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করবে সরকার।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে ‘বিদেশে পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধার: গৃহীত পদক্ষেপ, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ বিষয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকে জানানো হয়, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে ছয়টি দেশ ও অঞ্চলে সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। দেশ ও অঞ্চলগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং ও কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ।
মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকে রাশিয়ান ‘স্ল্যাশ ফান্ড’-এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কেমব্রিজ ডিকশনারি বলছে, যে অর্থ রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক অসাধু কাজের জন্য রাখা হয়।
বৈঠকের পর গতকাল সোমবার বেলা দুইটার দিকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বৈঠকে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে শফিকুল আলম বলেন, ২০০৯ থেকে গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার (ডলারপ্রতি ১২০ টাকা ধরে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা) বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে। এর মধ্যে ১৭বিলিয়ন ডলার (২ লাখ কোটি টাকা) পাচার হয়েছে ব্যাংকিং-ব্যবস্থা থেকে। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রথম থেকে বলে আসছেন পাচার করা টাকা ফেরত আনা তাঁদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের একটি।
আইন হচ্ছে শিগগিরই
পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১১ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এই টাস্কফোর্স এবং অন্যান্য সংস্থা-প্রতিষ্ঠান পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়ে কে কী করছে, অগ্রগতি কতটুকু, তা নিয়ে গতকাল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
অধ্যাপক ইউনূসের পাশাপাশি বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রায় দেড় ঘণ্টার বৈঠকে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে প্রেস সচিব বলেন, প্রথম সিদ্ধান্ত হলো, পাচার হওয়া এই টাকা কীভাবে ফেরত আনা যায়, সে বিষয়ে একটি বিশেষ আইন খুব শিগগির করা হবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই এই আইন দেখা যাবে। টাকা ফেরত আনার কাজটি ত্বরান্বিত করতে আইন লাগবে। যাঁরা এই টাকা ফেরত আনতে সাহায্য করছে, তাঁদেরও এটি চাহিদা।
পাচার টাকা ফেরত আনার বিষয়ে অনেকগুলো আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার ও টাস্কফোর্স কথা বলছে জানিয়ে প্রেস সচিব বলেন, আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতেও আইনটি সহায়তা করবে। ২০০টি আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা হয়েছে। এখনো প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়নি। ৩০টির মতো। আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হবে।
প্রেস সচিব বলেন, এখন থেকে প্রতি মাসে টাস্কফোর্সের বৈঠক হবে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর আরেকটি বৈঠক হবে। এ ছাড়া টাস্কফোর্সপ্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ মাসের ১৫ বা ১৬ মার্চ লন্ডনে যাবেন।
১১ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের টাকা উদ্ধারে অগ্রাধিকার
১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা প্রথমে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান প্রেস সচিব। তার মধ্যে প্রথমেই আছেন শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার।
প্রেস সচিব বলেন, বৈঠকে ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পাচার করা টাকা কোথায় কোথায় গেছে, কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেসব বিষয়ে অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ১১টি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বাইরেও আছেন কয়েক শ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, যাঁরা ২০০ কোটি বা তারও বেশি টাকা বাইরে নিয়ে গেছেন, সে বিষয়েও তদন্ত জোরদার করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে সংবাদ ব্রিফিংয়ে ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বিষয়ে তথ্য তুলে ধরেন প্রেস সচিব। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) যৌথ তদন্ত দল কাজ করছে। এ বিষয়ে দুটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে। ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা স্থিতিসহ ১১টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে এবং সব ব্যাংক হিসেবের তথ্য দুদকে পাঠানো হয়েছে। যৌথ তদন্ত দল বিভিন্ন দেশে তাঁদের সম্পদের সন্ধান পেয়েছে।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে আরও জানানো হয়, শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ১২৪টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব হিসাবে মোট টাকা রয়েছে ৬৩৫ কোটি ১৪ লাখ। রাজউকের ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ৬০ কাঠার প্লট পাওয়া গেছে। ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দামের ১০ শতাংশ জমিসহ ৮টি ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে মোট ছয়টি মামলা হয়েছে। ছয়টি মামলার তদন্ত শেষে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। শেখ হাসিনার পরিবারের সাত সদস্যকে আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা ছাড়া তাঁর পরিবার ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কারও নাম উল্লেখ করেননি প্রেস সচিব। তিনি বলেছেন, তদন্তের স্বার্থে সব নাম বলতে পারছেন না।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের টাকা পাচারের তথ্য ও উদ্ধারসংক্রান্ত অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি বলেন, জালিয়াতি, প্রতারণা এবং অন্যান্য অপরাধমূলক অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলো তদন্তাধীন। কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ১১টি মামলার তদন্ত করছে। আদালতের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে ২০ কোটি টাকা মূল্যের চারটি সম্পত্তি। দুটি ফ্ল্যাট এবং ৩১ হাজার ৫৯৪ শতাংশের বেশি সম্পত্তি জব্দের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে অবরুদ্ধ করা হয়েছে ৩৯টি ব্যাংক হিসাব, যাতে টাকা আছে ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া ১০২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে ৭টি এবং যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি সম্পত্তি জব্দ করার জন্য বলেছে সরকার।
সন্তানের সেমিস্টার ফির নামে পাচার ৪০০ কোটি টাকা
প্রেস সচিব বলেন, বৈঠকে এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান জানিয়েছেন, একটি ঘটনায় দেখা গেছে, এক ব্যক্তি তাঁর সন্তানের টিউশন ফি (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার খরচ) পাঠিয়েছেন ৪০০ কোটি টাকার ওপরে। এটি এক সেমিস্টারে নিয়েছে। তবে এই কাজ কে করেছেন, তা বলেননি প্রেস সচিব।
পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার সময়সাপেক্ষ উল্লেখ করে শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা আশা করছি, এ বছর নাগাদ কয়েক বিলিয়ন ডলার উদ্ধার করতে পারব, যদি সেই অনুযায়ী অগ্রগতি করতে পারি। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে একটি দিন যেন নষ্ট করা না হয়।’
সংবাদ ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, অপূর্ব জাহাঙ্গীর, সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি।
আইন করাটি ইতিবাচক
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন করাটি ইতিবাচক। বর্তমানে এ বিষয়ে আইনি কাঠামোয় কিছু ঘাটতি আছে বলে মনে করেন তারা। সে ক্ষেত্রে আইন করাটি হবে ইতিবাচক। তাই বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে যুগোপযোগী আইনি কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।