হিমাগারে আলু সংরক্ষণ ভাড়া কমিয়ে আনতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ও বিদ্যুৎ বিল কমানোর দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। একইসঙ্গে আলু চাষকারী কৃষকদের সুরক্ষা প্রদানের জন্য হিমাগার শিল্পকে কৃষিভিত্তিক শিল্প ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন সংগঠনটি।
শনিবার রাজধানীতে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয়ে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এসব দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু।
তিনি বলেন, দেশে ২০২৪ সালে চাহিদার তুলনায় কম আলু উৎপাদন হওয়ায় আলুর বাজারমূল্য বেশি ছিল। গত বছর আলুর বাজারদর বেশি থাকায় এবছর ২০২৫ সালে সারাদেশে কৃষকগণ ব্যাপকভাবে আলু চাষ করেছেন। যা গত ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ আলু বেশি উৎপাদন হবে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন আলু বাজারে এসেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকেই হিমাগারসমূহে কৃষকদের উৎপাদিত আলু সংরক্ষণ করা শুরু হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে হিমাগারের পরিচালনার জন্য গৃহীত ব্যাংক ঋণের সুদের হার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সঠিক সময়ে কিস্তি প্রদান করতে না পারলে জরিমানা ২ শতাংশসহ মোট ১৭ শতাংশে দাঁড়ায়। বিদ্যুৎ বিল, লোডিং-আনলোডিং ও বস্তা পরিবর্তন (পাল্টানি) খরচ, ন্যূনতম মজুরি বোর্ড ঘোষিত স্টাফদের বর্ধিত বেতনভাতা, বোনাস, সম্মানি, হিমাগারের ইন্স্যুরেন্স, অ্যামোনিয়া গ্যাস, লুব্রিকেন্ট অয়েল খরচ, হিমাগারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও মেরামত খরচ, অন্যান্য আনুসাঙ্গিক খরচও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সকল খরচগুলো বিশ্লেষণ করে ২০২৫ সালে হিমাগারে আলু সংরক্ষণে কেজি প্রতি ভাড়া দাঁড়ায় ৯ টাকা ৬২ পয়সা। এরসঙ্গে আরও অনেক খরচ আছে যা যোগ করলে প্রতি কেজি আলুর ভাড়া দাঁড়াবে প্রায় ১২ টাকা। দেশের আলু চাষকারী কৃষক এবং হিমাগারে আলু সংরক্ষণকারী ব্যবসায়ীগণের আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের গত ২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আর্থিক বিশ্লেষণে প্রাপ্ত কেজি প্রতি ভাড়া ৯.৬২ টাকার পরিবর্তে কেজি প্রতি ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক ২০১৭ সালে ৫০ কেজি আলুর বস্তা হিমাগারে সংরক্ষণ করা হলেও পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সাল হতে ক্রমান্বয়ে প্রতি বছর ৫৫ কেজি হতে ২০২৪ সালে ৭০ থেকে ৭২ কেজি আলু বস্তায় ভরে হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ২০২৪ সালে অ্যাসোসিয়েশন নির্ধারিত হিমাগারে আলু সংরক্ষণ ভাড়া ছিল কেজি প্রতি ৭ টাকা। সে হিসাবে ৫০ কেজির বস্তার আলু ভাড়া ৩৫০ টাকা। আলু সংরক্ষণকারীগণ ৭০ থেকে ৭২ কেজি ওজনের বস্তার ভাড়া ৩৫০টাকা প্রদান করেই হিমাগার থেকে আলু বের করেছেন। ফলে হিমাগার মালিকগণ প্রতি বস্তায় ১৫ থেকে ২২ কেজি আলুর ভাড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে হিমাগারের আলু ধারণক্ষমতা প্রায় ২০-২৫ শতাংম কমে গিয়েছে। গড়ে ১০ হাজার মেট্রিক টনের একটি হিমাগার প্রায় দেড় কোটি থেকে ২ কোটি টাকার মতো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ফলে দেশের চারশত হিমাগারের মধ্যে প্রায় তিনশত হিমাগার সময়মত ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে এবং অন্যান্য পরিচালনা ব্যয় সংকুলান করতে না পেরে রূগ্ন হিমাগারে পরিণত হয়েছে এবং বেশ কিছু হিমাগার ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কিছু স্থানে কিছু সুবিধাভোগী মানুষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বাস্তবতার নিরীখে হিমাগার পরিচালনার আবশ্যকীয় ব্যয় বিবেচনায় না নিয়ে তাদের মনগড়া বক্তব্য প্রদান করে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও অনুষ্ঠানে জানানো হয়।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ২০২৪ সালে আর্থিক বিশ্লেষণের আলোকে কেজি প্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ টাকা করে। কিন্তু কিছু মধ্যস্বত্তভোগী ও সুবিধাভোগী মানুষ সত্য গোপন করে বলছেন গত ২০২৪ সালে কেজি প্রতি ভাড়া ছিল ৪ টাকা। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য দেশের হিমাগার শিল্পের সুষ্ঠু পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি করবে বিধায় আপনাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকলের সদয় অবগতির জন্য এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছি। গত ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৭ সালে আলুর বাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ মূল্যহ্রাস ঘটে। ফলে হিমাগারে আলু সংরক্ষণকারী অনেক কৃষক ও ব্যবসায়ী হিমাগারে সংরক্ষিত আলু বের না করায় হিমাগার মালিকগণ ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েন। ফলশ্রুতিতে ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের কিস্তি নিয়মমাফিক পরিশোধ করতে না পারায় বিভিন্ন আর্থিক চাপ ও সমস্যা নিয়ে হিমাগার পরিচালনা করছেন যা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এ অবস্থায় যদি কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ তাদের ব্যক্তি সুবিধা চরিতার্থ করার জন্য হিমাগারে আলু সংরক্ষণে কেজি প্রতি ভাড়া অযৈাক্তিকভাবে কমানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করেন-তাহলে আর্থিক সংকটে থাকা হিমাগার পরিচালনা করতে পারবে না হিমাগার মালিকগণ। এতে আলু উৎপাদনকারী কৃষকগণ, এ খাতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীগণ এবং হিমাগার মালিকগণ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বেন এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়াসহ ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু আরও বলেন, ১০ হাজার মেট্রিক টনের একটি হিমাগারের অনুকূলে গৃহীত ব্যাংক ঋণের উপর যে সুদ আসে তা কেজি প্রতি আলু সংরক্ষণে রূপান্তর করলে দাঁড়ায় ৫ টাকা ৮৬ পয়সা এবং এর সঙ্গে বিদ্যুৎ খরচ ১ টাকা ১০ পয়সা যোগ করলে দাঁড়ায় ৬ টাকা ৯৬ পয়সা। এই ৬ টাকা ৯৬ পয়সা যাচ্ছে ব্যাংক ঋণের কিস্তি (আসল+সুদ) এবং বিদ্যুৎ বিল প্রদান করতে এবং এটিই মূল খরচ। যদি হিমাগারগুলো আর্থিকভাবে অসমর্থ হয়ে পড়ে তাহলে নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে না পারে, তবে নিয়মমাফিক বিদ্যুৎ বিভাগ পরের মাসে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এতে হিমাগারে সংরক্ষিত আলু নষ্ট হয়ে যাবে যা আলু সংরক্ষণকারী ও হিমাগার মালিক উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, আলু চাষকারী কৃষকদেরকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য যদি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ ভাড়া কৃষকদের সহনীয় পর্যায়ে আনতে হয় তবে হিমাগার শিল্পকে কৃষিভিত্তিক শিল্প ঘোষণা করে সরকারকে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে-বর্তমানে প্রচলিত দণ্ডসুদ সহ ব্যাংক ঋণের সুদ শতকরা ১৭ ভাগ থেকে কমিয়ে শতকরা ৭ ভাগ করতে হবে। বিদ্যুৎ বিলের ইউনিট প্রতি রেট পিক আওয়ারে ১৩.৬২ টাকা ও অফপিক আওয়ারে ৯.৬২ টাকার স্থলে ৫ টাকা করতে হবে। ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে। উৎসে কর কর্তন (টিডিএস) প্রত্যাহার করতে হবে। ত্রৈমাসিক ঋণের কিস্তির পরিবর্তে ঋণের কিস্তি বাৎসরিক করতে হবে।