কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্য হলুদ-কালো ট্যাক্সি। পুরনো দিনের বাংলা সিনেমায় প্রায়শই চোখে পড়তো সেই হলুদ ট্যাক্সির ছুটে যাওয়ার দৃশ্য। এক কথায় ব্যস্ত শহরের অন্যতম নিদর্শন ছিল এই যান। কলকাতা শহরতলির পাশাপাশি সল্টলেক, নিউ টাউনের মতো এলাকাতেও হলুদ ট্যাক্সির আনাগোনা ছিল। এই ট্যাক্সিকে ‘দ্য সিটি অফ জয়’র সমর্থক শব্দ বললেও একেবারে ভুল বলা হবে না। কিন্তু আইনের কারণে আজ কার্যত বিলুপ্তির পথে সেই চার চাকার যান।
আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ পর্যায়ক্রমে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫০০ মিটারযুক্ত হলুদ ট্যাক্সি বন্ধ হয়ে যাবে। যার অন্যতম কারণ ১৫ বছরের বেশি পুরনো বাণিজ্যিক যানবাহন শহরে চলাচলের অনুমতি নেই। শনিবার রাজ্যের পরিবহন দফতরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা একথা জানিয়েছেন।
রাজ্যে এই মুহূর্তে প্রায় ৪,৫০০ অ্যাম্বাসেডর মিটারযুক্ত হলুদ ট্যাক্সি রয়েছে। ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ সেই সংখ্যাটা ৩০০০-এ নেমে আসবে।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, ১৫ বছরের বেশি পুরনো যানবাহনকে শহরে চলতে দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে অনেক ট্যাক্সি ইউনিয়নগুলোর পক্ষে হলুদ ট্যাক্সিগুলোর বদলে একটি কার্যকর পুনরুজ্জীবন প্যাকেজের জন্য পরিবহন বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে।
ট্যাক্সি চালক ইউনিয়নগুলোর দাবি, মিটারযুক্ত অনেক হলুদ অ্যাম্বাসেডর ট্যাক্সি রাস্তায় চলাচলের যোগ্য এবং পরিবহন কর্তৃপক্ষ যদি ১৫ বছরের বয়সসীমা প্রত্যাহার করে, সেক্ষেত্রে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং ইঞ্জিন পরিবর্তন করে কমপক্ষে আরও পাঁচ বছর চালানোর অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
শনিবার শ্রমিক সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’র (আইএনটিইউসি) রাজ্য সভাপতি এবং ট্যাক্সি ইউনিয়নের নেতা প্রমোদ পান্ডে জানান, ২০১৯-২০ সালে কলকাতা শহরতলি এলাকা মিলিয়ে মোট হলুদ ট্যাক্সির সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। কিন্তু এরপর থেকে হলুদ ট্যাক্সের সংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালে এর সংখ্যা নেমে এসেছে ৮,৫০০-তে। আগামী এপ্রিলের মধ্যে হলুদ ট্যাক্সির সংখ্যা আরও কমতে চলেছে।
তার স্পষ্ট অভিমত, এই সঙ্কট এড়াতে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, আমরা তা জানতে চাই।
তার অভিযোগ, ২০১৬ সাল থেকে রাজ্যের পরিবহন বিভাগ হলুদ মিটারযুক্ত ট্যাক্সিগুলোর ভাড়া সংশোধন করেনি। উপরন্তু যেখানে বেশিরভাগ বয়স্ক ট্যাক্সি চালক অ্যাপ ক্যাব ব্যবহারই করতে পারেন না, সেখানে সরকার কার্যত মিটারযুক্ত হলুদ ট্যাক্সি সিস্টেমকেই নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে।
পান্ডে বলেন, ট্যাক্সি চালক, তাদের পরিবারের সদস্য এবং যারা হলুদ ট্যাক্সিকে ভালোবাসেন- এমন প্রায় ১০ হাজার মানুষ শিগগিরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে এই বিষয় তুলে ধরে একটি খোলা চিঠি পাঠাবেন। পাশাপাশি হলুদ মিটারযুক্ত ট্যাক্সির প্রতি রাজ্য সরকারের উদাসীনতার কারণে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে পরিবহন মন্ত্রী স্নেহাসিস চক্রবর্তীকে গোলাপ পাঠাবেন।
তিনি বলেন, বলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতা থেকে শুরু করে কলকাতার সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের মতো আইকনরা সবাই তাদের কাজে হলুদ ট্যাক্সিকে তুলে ধরেছিলেন। কলকাতা শহরে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরাও হলুদ ট্যাক্সিতে চড়ে ও সেলফি নেয়। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্য যদি হলুদ ট্যাক্সি বাঁচাতে কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তবে কলকাতার ইতিহাসের পাতা থেকে এই অংশটি চিরতরে চলে যাবে।
পরিবহন দফতরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, সরকার বিএস-৬ দূষণ বৃদ্ধির মাপকাঠি মেনে তৈরি মিটারযুক্ত ট্যাক্সির নতুন মডেল রাখার পক্ষে এবং সেক্ষেত্রে ট্যাক্সি মালিকদের ব্যাংক ঋণেরও সুবিধা দেবে।
তার অভিমত, পুরনো অ্যাম্বাসেডর মডেলগুলো ১৫ বছরের বেশি বয়স হয়ে গেলেই সেগুলোকে রেখে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। ২০০৮ সালে কলকাতা হাইকোর্ট পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিল ১৫ বছরের বেশি হয়ে গেলেই শহরে কোনোরকম বাণিজ্যিক যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে না। আমাদেরও সেই নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। তাই প্রতিটি স্টেকহোল্ডারের স্বার্থের কথা ভেবে আমাদেরও বিকল্প উপায় অনুসরণ করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে রাজ্য পরিবহন দফতর শিগগিরই ট্যাক্সি ইউনিয়নের সঙ্গে বৈঠকে বসবে বলেও জানান পরিবহন দফতরের এই কর্মকর্তা।