ইন্টারনেটের সহজলভ্য তথ্যপ্রবাহের যুগে, আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে জ্ঞান একসময় এত সহজে পাওয়া যেত না। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে, যখন ইসিডোর অব সেভিল জীবিত ছিলেন, তখন বই ছিল বিরল, গ্রন্থাগার অল্পসংখ্যক, আর অধিকাংশ মানুষই ছিল নিরক্ষর। ইসিডোর সেই যুগে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন জ্ঞান সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য। তার কাজকে সম্মান জানিয়ে ১৯৯৭ সালে পোপ জন পল দ্বিতীয় তাকে ‘ইন্টারনেটের পৃষ্ঠপোষক সাধু’ উপাধি দেন।
ইসিডোর ছিলেন সেভিলের একজন বিশপ ও পণ্ডিত। তিনি এমন একটি সময়ে বসবাস করতেন, যাকে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপ ছিল অস্থিতিশীল; যুদ্ধ, মহামারি আর অজ্ঞতা তখনকার সমাজকে গ্রাস করেছিল। এই অন্ধকার যুগেও ইসিডোর বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞানই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে পারে। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এটিমোলজিয়া’ লিখে প্রাচীন জ্ঞান সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের জন্য সহজলভ্য করে তুলেছিলেন।
এটিমোলজিয়া ছিল বিশ্বের প্রথম দিককার এনসাইক্লোপিডিয়া। এতে ভাষা, বিজ্ঞান, ভূগোল, ধর্মতত্ত্বসহ নানা বিষয়ের ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। ইসিডোর বিশ্বাস করতেন, শব্দের উৎপত্তি বা ‘এটিমোলজি’ বোঝা মানুষের কাছে বিষয়বস্তুর গভীর অর্থ উন্মোচন করে। এই বইতে ইসিডোর প্রাচীন গ্রিক ও রোমান পণ্ডিতদের সঙ্গে খ্রিস্টান লেখকদের রচনা থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করেন। এটিই হয়ে ওঠে মধ্যযুগের ছাত্র ও পণ্ডিতদের জন্য জ্ঞানের ভাণ্ডার।
ইসিডোর শুধুমাত্র লেখক ছিলেন না, তিনি ছিলেন খ্রিস্টান গির্জার উচ্চপদস্থ নেতা। তিনি ভবিষ্যৎ ধর্মযাজকদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘ক্যাথেড্রাল স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল হয়ে ওঠে।
তিনি সবার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস করতেন। সাতটি ‘লিবারেল আর্টস’ (ব্যাকরণ, যুক্তিবিদ্যা, রেটরিক, জ্যামিতি, পাটিগণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও সংগীত) শিক্ষার গুরুত্ব প্রচার করে তিনি ইউরোপে শিক্ষা সংস্কৃতির প্রসারে ভূমিকা রাখেন।
ইন্টারনেট ও ইসিডোর: যুগে যুগে সংযোগ
ইন্টারনেটের মতো, ইসিডোরের ‘এটিমোলজিয়া’ বিভিন্ন তথ্য এক জায়গায় এনে মানুষের কাছে সহজলভ্য করেছিল। ইন্টারনেট যেমন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞান সংরক্ষণ ও ভাগ করে, তেমনই ইসিডোরের কাজও সেই যুগে একই ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৯৭ সালে ক্যাথলিক চার্চ তার এই অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে তাকে ইন্টারনেটের পৃষ্ঠপোষক সাধু ঘোষণা করে।
ইসিডোরের কাজ মধ্যযুগ এবং পরবর্তী যুগে জ্ঞানচর্চায় অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তার রচনা ছিল আটম, নবম শতকের কারোলিঞ্জীয় পুনর্জাগরণের সময় শিক্ষার অন্যতম প্রধান উৎস। আজকের ডিজিটাল যুগে, যখন তথ্য পাওয়া সহজ হলেও অনেক সময় ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্যও থাকে, ইসিডোরের মতো মানুষের কাজ আমাদের সত্য এবং নির্ভরযোগ্য জ্ঞান সংরক্ষণের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।
ইসিডোর বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং বৃহত্তর কল্যাণে কাজ করতে সহায়তা করে। তার এই দর্শন যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক থেকেছে।
বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল