অ্যাপল আর স্টিভ জবসের নাম প্রায় সমার্থক হলেও তিনি একা এই সংস্থাটি শুরু করেননি। অনেকেই জানেন এই সংস্থার পথ চলা শুরু হয়েছিল স্টিভ জবস এবং স্টিভ ওজনিয়াকের মিলিত প্রচেষ্টায়। ১৯৭৬ সালের এপ্রিলে, জবসের বাবা-মায়ের বাড়ির গ্যারাজে আত্মপ্রকাশ করে অ্যাপল। তখন জবসের বয়স ২১ বছর আর ওজনিয়াকের ২৬।
সেই সময় এই দুই যুবার লড়াইয়ে সঙ্গী ছিলেন তুলনামূলক অভিজ্ঞ এক ইঞ্জিনিয়ার। তার কথা অ্যাপলের ইতিহাসে খানিকটা উহ্যই রয়ে গেছে। সামান্য ভুলে তার নাম সেই ভাবে মনে রাখেনি তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়া। জানেন কি সেই তৃতীয় সহ-প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
তিনি রোনাল্ড জেরাল্ড ওয়েন। অ্যাপল তৈরির তৃতীয় কারিগর। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ একটি সংস্থার অংশীদার হয়েও মাত্র একটি ভুলের কারণে ‘ধনকুবেরের সম্পদ’ হাতছাড়া হয়ে যায় ওয়েনের। অ্যাপলেন ছেড়ে আসা অংশের মালিকানা তার হাতে থাকলে ইলন মাস্কের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী হিসাবে তার নাম শোভা পেত।
বর্তমানে অ্যাপল বিশ্বের সবচেয়ে দামি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। তার মোট সম্পদের পরিমাণ তিন লক্ষ ৭৯ হাজার কোটি ডলার। নভেম্বর থেকে সংস্থার স্টক ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অ্যাপলের যাত্রা শুরুর দিকে ওয়েনের হাতে ছিল সংস্থার ১০ শতাংশ মালিকানা। সেই অংশ যদি তিনি বিক্রি না করে দিতেন, তা হলে জীবনের গতিপথটাই পাল্টে যেত ওয়েনের। বিশ্বের তাবড় ধনকুবেরের সঙ্গে উচ্চারিত হত তার নাম।
সংস্থার সূচনালগ্নে তিনি জবস ও ওজনিয়াককে সহায়তা করলেও কেন হঠাৎ সংস্থা ছেড়ে দেন? জেনে নিন সেই ‘ঐতিহাসিক ভুল’-এর নেপথ্য কাহিনি।
ওহাইয়োর ক্লিভল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন ওয়েন। ছোট থেকেই কৌতূহলী ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালে তিনি নিউইয়র্কের স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস থেকে স্নাতক হন। পরে তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৭১ সালে ওয়েন সায়ান নামে নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম শুরু করেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মেধা থাকা সত্ত্বেও তার ব্যবসায়িক দক্ষতা তেমন ছিল না।
তার তৈরি সায়ান ক্ষতির মুখে পড়ে। বিনিয়োগকারীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে টাকা শোধ করতে হয় ওয়েনকে। এর পর তার সঙ্গে আলাপ হয় দুই তরুণ উদ্যোগপতি জবস ও ওজনিয়াকের। জবস নিজের বিভিন্ন ব্যবসায়িক ধারণা নিয়ে ওয়েনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।
অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রথমে জবসের প্রস্তাবে রাজি হতে চাননি ওয়েন। অনেক বিতর্ক এবং আলোচনার পর ওয়েন নতুন উদ্যোগে জবস এবং ওজনিয়াকের সংস্থায় যোগ দিতে সম্মত হন।
ওয়েনকে নতুন সংস্থার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডকুমেন্টেশন দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাকে ১০ শতাংশ মালিকানাও দেওয়া হয়। জবস এবং ওজনিয়াক প্রত্যেকেরই ৪৫ শতাংশ মালিকানা ছিল সংস্থায়।
ওয়েন অংশীদারিত্ব চুক্তির খসড়া তৈরি করেন, বাকি অংশীদারদের ভূমিকা কী হবে তা নির্ধারণ করেন এবং অ্যাপলের প্রথম লোগো তৈরি করেন। জবসের দায়িত্ব ছিল বিপণন এবং ওজনিয়াককে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই ত্রয়ী তাদের প্রথম যে পণ্যটি তৈরি করেছিলেন তা ছিল অ্যাপল আই কম্পিউটার।
প্রাথমিক সাফল্য সত্ত্বেও, অ্যাপলের প্রতি ওয়েন আস্থা হারাতে থাকেন। সংস্থাটি তৈরির মাত্র ১২ দিন পর ওয়েন পদত্যাগ করেন। তার আশঙ্কা ছিল ব্যবসা শুরুর জন্য যে টাকা তারা ধার নিয়েছেন তার দায় বর্তাবে ওয়েনের উপর। কারণ বাকি দুই অংশীদারের সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। উল্টো ওয়েনের ছিল একটি বাড়ি ও কিছু ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
তিনি ভেবেছিলেন ব্যবসায় লাভের মুখ না দেখলে সেই ঋণের দায় ওয়েনের উপর বর্তাবে। ফলস্বরূপ, ওয়েন সংস্থার চুক্তি থেকে তার নাম সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তার ১০ শতাংশ মালিকানা জবস এবং ওজনিয়াকের কাছে মাত্র ৮০০ ডলারে বিক্রি করেন।
আরও একটি সুযোগ ওয়েনের হাতে ছিল যা তিনি না বুঝেই হাতছাড়া করেন। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠার মূল চুক্তিটি নিজের কাছে রেখেছিলেন ওয়েন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালে মাত্র ৫০০ ডলারে সেটি বিক্রি করে দেন। ২০১১ সালে যেটির নিলামে সেটির দর ওঠে প্রায় ১৬ কোটি টাকা।
অ্যাপ্ল থেকে তাঁর প্রস্থানের পর ওয়েন ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান। তিনি ‘লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে’ কাজ করেন এবং পরে ‘এলডিএফ সেমিকন্ডাক্টরস’ নামে একটি সংস্থায় যোগ দেন। স্ট্যাম্প এবং দুর্লভ মুদ্রা সংগ্রহের ঝোঁক ছিল ওয়েনের। পরে তিনি একটি দোকান খোলেন। সেটিও এক সময় লোকসানের মুখ দেখে ও বন্ধ হয়ে যায়।
ওয়েনের ভাগ্য সব সময় তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে গিয়েছে। বাড়িতে ডাকাতি হওয়ার পর তিনি তার জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে ফেলেন। ব্যবসায়ে ক্ষতিপূরণের জন্য তাকে তার বাড়িটিও বিক্রি করতে হয়েছিল। তিনি এখন নেভাদার একটি ভ্রাম্যমাণ আশ্রয়ে থাকেন।
বিপুল সম্পদ হাতছাড়া হওয়ার পরও ওয়েনের এই নিয়ে কোনও অনুশোচনা নেই। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি অনুভব করেছিলাম যে অ্যাপলে আমার জন্য সীমিত সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে আমাকে পরবর্তী ২০ বছর কাগজপত্র পর্যালোচনা করতে করতে কাটিয়ে দিতে হত।’’