রপ্তানিতে জুয়েলারি খাতের সম্ভাবনা প্রবল, আছে চ্যালেঞ্জ

0

‘বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) হাত ধরে বাংলাদেশে এগিয়ে চলেছে জুয়েলারি শিল্প। বিদেশে পণ্য রপ্তানিতে এই খাতের সম্ভাবনাও প্রবল। তবে স্বর্ণ রপ্তানিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো মোকাবিলায় প্রয়োজন সমন্বয়সহ সরকারের নৈতিক সমর্থন। বিজিএমইএ যেমন পোশাক খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তেমনি জুয়েলারি খাতে বাজুসকে নেতৃত্ব দিয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে।’ 

শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বাজুস ফেয়ার ২০২৪-এ ‘স্বর্ণ নীতিমালা বাস্তবায়ন ও অলঙ্কার রপ্তানির সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার (আইসিসিবি) নবরাত্রি হলে এই ফেয়ার ও সেমিনারের আয়োজন করে দেশের ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ, জার্মানির বার্লিনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. জাফর উদ্দীন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান এ. এইচ. এম আহসান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শরীফ মোশাররফ হোসেন, অর্থনৈতিক বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম, বাজুসের সহ-সভাপতি মো. রিপনুল হাসান, বাজুসের কার্যনির্বাহী সদস্য ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন, জয়দেব সাহা প্রমুখ।

সেমিনারে ‘স্বর্ণ নীতিমালা বাস্তবায়ন’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ড. মাহফুজ কবির বলেন, স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়ে সংকটের সময়। যখন অন্যান্য খাতে সংকট তৈরি হয়, তখন মানুষ স্বর্ণে বিনিয়োগ করে। আমরা স্বর্ণ আমদানি করলেও আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের জুয়েলারির ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। তবে এজন্য স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধসহ দেশের বাজার সম্প্রসারণ প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, আমাদের যে স্বর্ণ নীতিমালা রয়েছে, সেটি ভালো। তবে সেটি বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এটা অনেক বড় সমস্যা। যে খাতটিকে আমরা বড় করতে চাই সেটিকে সুবিধা দিতে হবে। এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। তাই এই খাতের সম্প্রসারণে সরকারের পক্ষ থেকে নীতিগত সমর্থন দিতে হবে। তাহলে এতে বিনিয়োগ বাড়বে। যদি এই খাতে ট্যাক্স কমানো ও ছাড় দেওয়াসহ যদি ব্যাংক থেকে আর্থিক সাপোর্ট দেওয়া যায়, তাহলে এই খাত অনেক এগিয়ে যাবে।

‘অলংকার রপ্তানির সম্ভাবনা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, স্বর্ণের আন্তর্জাতিক বাজার মোটেও ছোট নয়। এর বাজার প্রায় ৪০০ বিলিয়নের মতো।  আমরা যদি এই বাজারে ঢুকতে পারি, তাহলে জায়গা করে নিতে খুব একটা সমস্যা হবে না। যেমনটা আমরা পোশাক শিল্পে করতে পেরেছি। তবে এতে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিজিএমইএ যেমন পোশাক খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তেমনি জুয়েলারি খাতে বাজুসকে নেতৃত্ব দিয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। তা না হলে আমরা ভালো করতে পারব না।

বাংলাদেশের জুয়েলারির ভিন্নতা রয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এটি আমাদের ঐতিহ্যও। তবে এটিকে আমরা ধরে রাখতে পারছি না। এটি আমাদের ব্যর্থতা। এমনকি জুয়েলারি ও স্বর্ণ নিয়ে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। তাই বাজুসকে জরিপ করে এটি করতে হবে। 

ড. আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, স্বর্ণ খাতে আমাদের পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো সমস্যা আছে। সেগুলো সমাধান না করা গেলে রপ্তানিতে এই খাত এগোবে না। এই খাতকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারলে বাজুসকে নিয়ে এই খাত অনেক দূর এগোবে।

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, বাজুস সবার মুখে মুখে পরিচিতি রাভ করেছে। এটি একটি ভালো লক্ষণ জুয়েলারি শিল্পে একটি সংগঠন দাঁড়িয়েছে। তারা কাজ করে এই খাতের একটি বিশাল ভবিষ্যৎ তৈরি করার চেষ্টা করছে। বাজুস প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীরের কথা শুনে মনে হয়েছে, তিনি স্বপ্ন দেখেছেন এবং স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করছেন।

তিনি আরও বলেন, আমরা স্বর্ণ নীতিমালা করেছিলাম। এই খাতে আমাদের কতগুলো সুবিধা রয়েছে, কতগুলো অসুবিধাও রয়েছে। আমাদের ভীষণ ভালো কারিগর রয়েছে। এটি একটি বড় সুবিধা। অর্ধেক স্বর্ণ দিয়ে তারা পুরো অলঙ্কার বানাতে পারে। একটি যেমন সাশ্রয়ী আবার একই পারপাস সার্ভ করে। অনেক বছর ধরে আমাদের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে আসছেন। অসুবিধা হলো আমাদের দেশে স্বর্ণের দাম বেশি, বাইরে কম। তাহলে আমরা এক্সপোর্ট করব কোথায়? এটা যদি আমরা অ্যাড্রেস করতে না পারি, তাহলে কঠিন হবে রপ্তানি করা। সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।

টিপু মুনশি বলেন, বাজুস নামটা পরিচিত হয়েছে, তবে লড়াইটা এখনো শুরু হয়নি। গার্মেন্টস সেক্টরে ৪০ বছর পরিশ্রম করে আজকে আমরা এই অবস্থানে এসেছি। অসংখ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা করেছি। সুতরাং, স্বর্ণ খাতেও লেগে থাকতে হবে, সমন্বয় করতে হবে এবং লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। আপনাদের ভীষণ রকম সুযোগ রয়েছে, সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

স্বর্ণ শিল্পের সম্ভাবনা প্রবল জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের কারিগর, উদ্যোক্তা আছে। শুধু লেগে থাকতে হবে। এটা ভালো আমাদের স্বর্ণ শোধনাগার হচ্ছে। আমরা চাই, যতটুকুই সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেটার পূর্ণ ব্যবহার হোক। আপনাদের লড়াই করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, আমাদের স্বর্ণ নীতিমালা ভালো। আমরা স্বর্ণ রপ্তানির দিকে এগোচ্ছি। কিন্তু আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, সমন্বয়ের অভাব আছে। সেগুলো আমাদের দূর করতে হবে। গোল্ডের জন্য কমিউনিটি এক্সচেঞ্জ করতে পারলে এই খাত রপ্তানিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, গার্মেন্টস খাতে সুবিধা দেওয়ায় সেটি অনেক উজ্জ্বল হয়েছে। উদীয়মান স্বর্ণ খাতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।  সরকারের পক্ষ থেকে সুবিধা না দিলে এই খাত এগোতে পারবে না।

বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. জাফর উদ্দীন বলেন, আমাদের কোনো স্বর্ণ শোধনাগার নেই। স্বর্ণ শোধনাগার প্রতিষ্ঠিত হলে এই খাত অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তবে পাশাপাশি আমাদের সরকারসহ সব অংশীদারদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। মার্কেট রিসার্চ বাড়াতে হবে এবং ভয় দূর করতে হবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান এ. এইচ. এম আহসান বলেন, বিদেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আমরা অনেকগুলো সম্ভাবনাময় খাত নির্ধারণ করেছিলাম। কিন্তু সেগুলো সফল হয়নি। স্বর্ণ নতুন এক সম্ভাবনাময় খাত। আমাদের নিজেদের জুয়েলারির প্রচার ও প্রসার করতে হবে। এই খাতের চ্যালেঞ্জগুলো দূর করতে পারলে এটি বাইরে রপ্তানি সম্ভব।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শরীফ মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পন্নোত দেশ থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য যেমন সুনামের, তেমনি অনেক নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি হবে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা সৃষ্টি হবে রপ্তানিতে। রপ্তানিতে আমাদের অনেক সুবিধা কমে যাবে। যার কারণে রপ্তানিও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। রপ্তানিযোগ্য খাত বের করে নৈতিক সমর্থন দিতে হবে। স্বর্ণ তেমন একটি খাত। যার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। কারণ আমাদের দক্ষ কারিগর আছে। তবে কাঁচামাল আমদানিতে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। শুল্ক কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে এই খাত এগিয়ে গিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে।

ইআরএফ-এর সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, স্বর্ণ নীতিমালা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। স্বর্ণ রপ্তানি করতে হলে আগে দেশের বাজারে সরবরাহ বাড়াতে হবে।

বাজুসের কার্যনির্বাহী সদস্য ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা আমাদের স্বর্ণ নীতিমালা দিয়েছেন। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এতে ভূমিকা রেখেছেন। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। জুয়েলারি শিল্পকে এগিয়ে নিতে শুল্ক কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে।

বাজুসের কার্যনির্বাহী সদস্য জয়দেব সাহা বলেন, আমাদের প্রেসিডেন্ট যে ভিশন দেখিয়েছেন, সেটা নিয়ে আমরা এগোতে চাই। এজন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।

সভাপতির বক্তব্যে বাজুসের সহ-সভাপতি গুলজার আহমেদ বলেন, অনেকদিন পর স্বর্ণ রপ্তানির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) আইসিসিবিতে ‘সোনায় বিনিয়োগ, ভবিষ্যতের সঞ্চয়’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে শুরু হয় তিন দিনের বাজুস ফেয়ার ২০২৪। মেলার উদ্বোধন করেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীর। বিশ্ববাজারে দেশের স্বর্ণশিল্পীদের হাতে গড়া অলঙ্কারের পরিচিতি বাড়াতে এই মেলার আয়োজন করা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here