টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব : মামাতো বোন-মামি ও মামাকে হত্যা করে ভাগ্নে

0

সিরাজগঞ্জের তাড়াশে বাবা-মা ও মেয়েকে গলা কেটে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। একই সাথে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত বিকাশ সরকারের বড় বোনের ছেলে অর্থাৎ আপন ভাগ্নে রাজিব ভৌমিককে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। 

আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ভাগ্নে রাজিব কুমার ভৌমিক হতাশাগ্রস্ত থেকে তার মামা-মামি ও মামাতো বোনকে গলা কেটে হত্যা করেছে। 

আটক রাজিব ভৌমিক উল্লাপাড়া উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের মৃত বিশ্বনাথের ছেলে। অন্যদিকে, নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা হত্যাকারী যেই হোক না কেন তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। 

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল জানান, সিরাজগঞ্জের তাড়াশের বারোয়ারী বটতলা নিজ বাড়ির তিন তলার একটি ফ্লাট থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বিকাশ সরকার, তার স্ত্রী স্বর্না সরকার ও একমাত্র মেয়ে তাড়াশ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী পারমিতা সরকার তুষির গলা কাটা ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। মর্মান্তিক ও চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন এবং আসামিকে গ্রেফতারের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সামিউল আলমের নেতৃত্বে পুলিশ ও ডিবির ২০ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়। নিরলস পরিশ্রমের কারণে হত্যাকাণ্ডের ১২ ঘণ্টার মধ্যে রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে এবং আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

তিনি আরও জানান, প্রথমে হত্যাকাণ্ডের শিকার বিকাশ সরকারের একটি মোবাইল রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়। রেকর্ডের একপ্রান্তে বিকাশ সরকার এবং অন্যপ্রান্তে ভাগ্নে রাজিব ভৌমিকের কিছু কথোপকথন শোনা যায়। এর সূত্র ধরেই রাজিব কুমার ভৌমিককে বিকেলে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর রাজিব কুমার ভৌমিক হত্যাকাণ্ডের সাথে একাই জড়িত বলে স্বীকার করে হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন। 

আসামি রাজিবের দেওয়া স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, আসামি রাজিব ভৌমিকের বাবা ২০১৯ সালে মারা যায়। এরপর থেকেই রাজিব ভৌমিক পরিবারের হাল ধরেন। একই সাথে তার মামা বিকাশ সরকারের সাথে খাদ্যশস্য মজুতের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় বিকাশ সরকার ভাগ্নে রাজিবকে ২০ লাখ টাকা প্রদান করেন। রাজিব ভৌমিক পর্যায়ক্রমে মামাকে ২৬ লাখ টাকা ফেরত দিলেও মামা আরও ৩৬ লাখ টাকা পাবেন বলে দাবি করেন। আর টাকার জন্য মামি ও মামাতো বোন ভাগ্নে রাজিবকে বারবার তাগাদা দেন।

সর্বশেষ গত বুধবার টাকার জন্য তারা ভাগ্নে রাজিব ও তার মাকে বকাঝকা করেন। এছাড়াও এনজিও থেকে মায়ের নামে সুদে টাকা তোলায় হতাশায় ভুগছিল রাজিব কুমার ভৌমিক। এসব কারণেই ক্ষুদ্ধ ও হতাশায় পড়ে রাজিব ভৌমিক তার মামাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মাফিক রাজিব শনিবার বিকেলে প্রথমে মামাকে ফোন করে বলেন টাকা ফেরত দিব আমি আপনার বাসায় যাচ্ছি আপনি বাসায় আসেন। ওই সময় বিকাশ তাকে বাড়িতে গিয়ে বসতে বলেন। তখন রাজিব বাড়ি থেকে ব্যাগের মধ্যে একটি হাসুয়া ও স্থানীয় প্রতাপ বাজারের একটি দোকান থেকে তিন কেজি ওজনের একটি রড কিনে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে তাড়াশে মামার বাড়িতে যায়। বাড়িতে ঢোকার পর মামী স্বর্না রানী তাকে বসতে বলেন এবং ভাগ্নেকে কফি খাওয়ানোর জন্য তিনতলা থেকে নিচে নেমে কফি কিনতে বাইরে দোকানে যায়।

এ সময় রাজিবের মামাতো বোন পারমিতা সরকার তুষি টাকার লেনদেনের বিষয়টি তুলে বলে ভাইয়া আপনি টাকা দিচ্ছেন না কেন? এ নিয়ে মাঝে-মধ্যেই মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হয়। টাকাগুলো দিয়ে দেন। এতে রাজিব ক্ষুদ্ধ হয়ে তুষির মাথায় রড দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করে। এরপর মামি কফি নিয়ে ঘরে ঢুকে তুষির রুমের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকেও রড দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করে। এর ১০ মিনিট পর মামা বিকাশ সরকার দরজায় নক করে। এ সময় রাজিব দরজা খুলে দেবার পর বিকাশ সরকার ঘরে ঢোকামাত্রই তাকে রড দিয়ে আঘাত করে। এরপর রাজিব ব্যাগ থেকে হাসুয়া বের করে একে একে তিনজনকে গলা কেটে ঘরে তালা লাগিয়ে বাসা থেকে বের হয়। পরে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি যাওয়ার পথে চালমাগুড়া এলাকায় উৎপল সরকারের পুকুরে রড ফেলে দেয় এবং হাসুয়াটি ব্যাগে ভরে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায়। কেউ যাতে সন্দেহ না করে ওই রাতে সেও তার মামার ফোনে কল দিয়েছিল। 

তিনি আরও জানান, এরপর দু’দিনেও যখন স্বজনরা বিকাশ, তার স্ত্রী স্বর্না ও মেয়ে তুষির খোঁজ পায় না এবং মোবাইলও রিসিভ হয় না। তখন বিকাশ সরকারের আরেক ভাগ্নে লিপুন বগুড়ার শেরপুর থেকে তাড়াশে আসেন এবং হত্যাকারী রাজিবকে সাথে নিয়ে তার মামার বাড়িতে যায়। এ সময় তালাবাদ্ধ দেখে পুনরায় কল করে দেখে ঘরে ফোনের আওয়াজ শোনা যায়। এতে তাদের সন্দেহ হলে পুলিশকে সংবাদ দেয়। 

তিনি জানান, তালাবদ্ধ দেখে অন্যান্য স্বজনদের সাথে রাজিবও তাড়াশ থানায় যায় এবং পুলিশকে সাথে এনে দরজা ভাঙ্গে। রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত আসামি রাজিব স্বজনদের সাথেই ছিল। 

পুলিশ সুপার বলেন, অডিও শোনার পরই বিকেলে রাজিবকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক পুকুর থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রড এবং তার নিজ বাড়ি থেকে রক্ত মাখা হাসুয়া উদ্ধার করা হয়েছে। 

পুলিশ সুপার আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিকাশ সরকারের স্ত্রীর ভাই শ্রী সুকোমল চন্দ্র সাহা বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলায় তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে। 

এদিকে, নিহত বিকাশ সরকারের মা শান্তি বেলা ও ভাগ্নে লিপুন বলেন, হত্যাকারী যেই হোক কেন তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে পারে বলে তারা মন্তব্য করেন। 

পুলিশ সুপার কার্যলয়ের হলরুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রিন্ট এবং ইলেট্রেনিক্স মিডিয়ার সংবাদ কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here