গত ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নৃশংস বোমা হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এরই মধ্যে সেখানে ১১ হাজার তিন শতাধিক ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আট হাজারের বেশি নারী ও শিশু। ইসরায়েলের এই অপরাধযজ্ঞের কারণে বিশ্বজুড়ে বইছে নিন্দার ঝড়।
তুরস্কের কর্মকর্তারাও ইসরায়েলি নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে নানা সমালোচনা করছেন। এমনকি দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান সর্বশেষ মন্তব্যে ইসরায়েলকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়ছেন।
তুর্কি নেতারা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদেরকে নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জাতির সমর্থক ও রক্ষক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- ইসরায়েলের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ইসরায়েলে মৌলিক পণ্য রফতানির মাধ্যমে তুরস্ক সরকার যতটা সম্ভব এই দখলদার সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
এ প্রসঙ্গে, তুরস্কের বিখ্যাত অর্থনৈতিক ভাষ্যকার ইব্রাহিম কাহভেচি স্পষ্ট পরিসংখ্যান তুলে ধরে, তুরস্ক থেকে ইসরায়েলে পণ্য রফতানির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি তার পরিসংখ্যানে বলেছেন, ‘ইসরায়েলে তুরস্কের পণ্য রফতানি থেকে বোঝা যায়, আঙ্কারার কর্মকর্তারা কেবল দেশের অভ্যন্তরে জনগণের সমর্থন লাভের জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিচ্ছেন কিন্তু পর্দার আড়ালে আসল বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরায়েলের সাথে তুরস্কের বাণিজ্য তো থামেনি বরং আগের চেয়ে আরো বেড়েছে।
তুরস্কের এই খ্যাতনামা অর্থনৈতিক ভাষ্যকার রেস্তোরাঁর খাদ্য তালিকা থেকে কোকাকোলা ও নেসক্যাফের মতো অতি নিম্ন-মূল্যের ইসরায়েলি পণ্যগুলো অপসারণ ও ইসরায়েলের কাছে ৬০০ কোটি ডলার মূল্যের ‘স্টিল’-এর মতো কৌশলগত পণ্য রফতানিকে তুরস্ক সরকারের ভণ্ডামি হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এদিকে, তুর্কি পণ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান টিআইএম-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুর্কি সরকার জার্মানির সমপরিমাণে পণ্য ইসরায়েলে রফতানি করে থাকে এবং চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই তুরস্কের অবস্থান। অন্য কথায়, ইসরায়েলের মৌলিক চাহিদা প্রদানে তুরস্ক ও জার্মানি যৌথভাবে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
টিআইএম-এর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘তুরস্ক ২০২২ সালে ইসরায়েলে ১১৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের লোহা ও ইস্পাত রফতানি করেছে। এছাড়া, ৫৬ কেটি ৩০ লাখ ডলার মূল্যের তুর্কি গাড়ি ইসরায়েলে রফতানি করা হয়েছে। ৫১ কোটি ২০ লাখ ডলার মূল্যের প্লাস্টিকজাত সামগ্রী রফতানি করে তুরস্ক তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।’
কাহভেচির মতে, তুরস্কের পার্লামেন্টের ক্যাফেটেরিয়া, টিহাউস এবং রেস্তোঁরাগুলোতে ইসরায়েলকে সমর্থনে সুপরিচিত কোম্পানিগুলোর পণ্য আর বিক্রি না করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি নিছক প্রতীকী ছিল। কারণ তুরস্ক ইসরায়েলের কাছে তার কৌশলগত ইস্পাত বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছে।
যদিও সংসদ সিদ্ধান্তের জন্য তার ঘোষণায় কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের উল্লেখ করেনি, রয়টার্স গত সপ্তাহে একটি সংসদীয় সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, কোকা-কোলা পানীয় এবং নেসলে ইনস্ট্যান্ট কফিই একমাত্র ব্র্যান্ড মেনু থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কাহভেচি আরো দাবি করেছেন, তুরস্কের তুর্কি গোষ্ঠীগুলোর সাথে যুক্ত সংস্থাগুলো সংসদ এবং তুর্কি জনসাধারণের দ্বারা বয়কট করা ইসরায়েলি ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে, এই বলে সরকার জনগণকে বিশ্বাস করাতে চায় যে এসব কোম্পানিগুলোকে বয়কট করে ইসরায়েলকে থামিয়ে দেবে।
“আপনি কি ইসরায়েলের কাছে কৌশলগত পণ্য, বিশেষ করে বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত পণ্য বিক্রির উপর কোনো বিধিনিষেধের কথা শুনেছেন?” পাঠকদের উদ্দেশ্যে সাংবাদিকের জিজ্ঞাসা।
কাহভেচি এই বিষয়টির সমালোচনা করে বলেছেন, ইসরায়েল-বিরোধী বিক্ষোভ, যখন যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশগুলোতে কয়েক হাজার অংশগ্রহণকারী প্রতি সপ্তাহান্তে চলতে থাকে, তুরস্কের ক্ষমতাসীন জোট বিরোধী দলগুলোর কোনো সদস্যকে বাধা না দিয়ে শুধুমাত্র একটি সমাবেশের আয়োজন করেছে।
“কেন প্রতি সপ্তাহান্তে নিষ্ঠুর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আমাদের রাস্তা পূর্ণ হয় না? …এমনকি ইসরায়েলেও তুরস্কের চেয়ে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বেশি বিক্ষোভ হয়েছে,” কাহভেচির দাবি।
এদিকে, সাংবাদিক মেটিন সিহান একাধিক টুইট বার্তায় বলেছেন, ইসরায়েল-হামাস সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ২৫৩টি জাহাজ তুরস্ক থেকে ইসরায়েলের দিকে রওনা হয়েছে, যা অপরিশোধিত তেল, জ্বালানি, লোহা এবং ইস্পাতের মতো পণ্যসম্ভার বহন করে। সিহান তুরস্ক থেকে ইসরায়েলে পণ্য পরিবহনকারী জাহাজের একটি তালিকাও শেয়ার করেছেন। সূত্র: তার্কিশ মিনিট