সরকার ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের অর্থায়নে ঢাকার কেরাণীগঞ্জ এলাকাকে অপরাধমুক্ত রাখতে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) মাধ্যমে নজরদারি কার্যক্রম শুরু করলো পুলিশ। এই কার্যক্রমে কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার আওতাধীন পাঁচটি ইউনিয়নকে ২০০টি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বিকালে কেরাণীগঞ্জের সেমন্তী কনভেনশন হলে এ কর্মযজ্ঞের উদ্বোধন করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ। ঢাকা জেলা পুলিশের উদ্যোগে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে অর্থায়ন করছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বক্তব্যের শুরুতে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থায়নকারী বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, কেরাণীগঞ্জকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দিতে বসুন্ধরা গ্রুপ এগিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, কেরাণীগঞ্জের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বসুন্ধরা গ্রুপকে আমরা পাশে পেয়েছি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে অঙ্গীকার সেটি বাস্তবায়নে পুলিশ বাহিনী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কেরাণীগঞ্জের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকা জেলা পুলিশের এই উদ্যোগ তারই অংশ। পুলিশ বাহিনী নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত শান্তি সমাবেশের নামে ঢাকাসহ সারা দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি করেছে, সেখানেও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বজায় রাখতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা আত্মাহুতি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, এক সময় কেরাণীগঞ্জে সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল। সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে কেরাণীগঞ্জে কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারতো না। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতো। সেই অবস্থা এখন আর নেই। আমরা কেরাণীগঞ্জকে শান্তির জনপদে পরিণত করেছি। এতে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকার কথাও না বললেই নয়।
নসরুল হামিদ বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা জোরদারে আরও একধাপ এগিয়ে গেল কেরাণীগঞ্জ। এই ধরনের সিসিটিভি দেশের আধুনিক এলাকা ছাড়া আর কোথাও নেই। কেরাণীগঞ্জে যে সিসিটিভি ক্যামেরা বসতে যাচ্ছে, সেগুলো খুবই অত্যাধুনিক। প্রতিটি অলি-গলিতে আমরা ক্যামেরা স্থাপন করবো। এর মধ্য দিয়ে কেরাণীগঞ্জের মানুষকে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা নিরাপত্তা দিয়ে যাবে পুলিশ। ২০২৪ সালের মধ্যে আমরা কেরাণীগঞ্জকে শতভাগ অপরাধমুক্ত ঘোষণা করব ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, ১৯০৫ সালে ঢাকার নবাববাড়িতে প্রথম বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপিত হয়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৯৭ বছরে পাকিস্তান শাসনামলসহ সব সরকারের নেতৃত্বে মাত্র ৪৭ শতাংশ বিদ্যুতায়ন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৩ বছরে আমরা সারা দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে পেরেছি। এখন সমগ্র বাংলাদেশ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত।
ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান। আরও অতিথি ছিলেন কেরাণীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক ম ই মামুন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন কেরাণীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন কবির। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহজামান।
এসময় উপস্থিত ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সেক্রেটারি ও নির্বাহী পরিচালক মাকসুদুর রহমান, চিফ প্রটোকল অফিসার মেজর (অব.) মোহসীনুল, একান্ত সচিব আমিনুল ইসলাম, বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ডিজিএম মো. শ্যামল, দৈনিক কালের কণ্ঠের উপ-সম্পাদক হায়দার আলী, নিউজটোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের ডেপুটি সিএনই আশিকুর রহমান শ্রাবণ, বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সেক্রেটারিয়েট টিমের সদস্য রণিত সেন, মারুফ কাজী ও সোহেল।
অনুষ্ঠানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান, ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর শাহ খুশী, সাকুর হোসেন সাকু, সাইদুর রহমান চৌধুরী ফারুক, ব্যবসায়ী স্বাধীন শেখ প্রমুখ।
উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক সৈয়দ নুরুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের যে সুফল কেরাণীগঞ্জের মানুষ পাবে, তার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত সড়কে ব্যাপক ডাকাতির ঘটনা ঘটতো। আমি দায়বদ্ধতা থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটারজুড়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে দিয়েছিলাম। এরপর থেকে ডাকাতি, অতিরিক্ত গতিতে গাড়িচালনা থেকে শুরু করে অপরাধ কর্মকাণ্ড অনেকাংশেই লাঘব হয়ে গেছে। কোনো এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলে যেকোনো অপরাধী অপরাধ সংঘটনের আগে চিন্তা-ভাবনা করবে। কেরাণীগঞ্জে যে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে, সেটি হবে দেশের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির। এ কাজে এগিয়ে এসে বসুন্ধরা গ্রুপ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা জোরদারে বড় অবদান রাখল।
কেরাণীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কেরাণীগঞ্জ দক্ষিণ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, অনেকগুলো চোখ, যা দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা কেরাণীগঞ্জের মানুষকে নিরাপত্তা দেবে, সেই চোখগুলোর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আজ। নাগরিকদের নিরাপত্তায় প্রশাসনের পাশাপাশি এই সিসিটিভি ক্যামেরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি কেরাণীগঞ্জবাসীর জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসায় কেরাণীগঞ্জবাসীর পক্ষ থেকে আমি বসুন্ধরা গ্রুপকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন, তারই অংশ এটি। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের ফলে কেরাণীগঞ্জের ৯৯ শতাংশ অপরাধ দমন হবে বলে আমি মনে করি।
সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম বলেন, সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে সোনার মানুষ লাগে। দক্ষ জনশক্তি এবং প্রযুক্তির মেলবন্ধন এই দেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। রাষ্ট্রের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্তকারী অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে সিসিটিভি নজরদারি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকা জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। এটি বাস্তবায়নে বসুন্ধরা গ্রুপের মতো একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এগিয়ে এসেছে, তা আমাদের আরও অনুপ্রাণিত করেছে।
দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ম. ই. মামুন বলেন, প্রতিটি নাগরিকের সব নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কেরাণীগঞ্জে সে কাজটি শুরু হচ্ছে, এটি খুবই প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের নেতৃত্বে কেরাণীগঞ্জকে অপরাধমুক্ত করতে বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মধ্য দিয়ে সেই পদক্ষেপ আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।
কেরাণীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহাবুদ্দিন কবীর বলেন, কেরাণীগঞ্জ একটি উন্নয়নশীল এলাকা। আবাসনের পাশাপাশি এখানে প্রচুর শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই এলাকায় ভাসমান লোকের সংখ্যা বেশি। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা পুরো কেরাণীগঞ্জ এলাকাকে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করি। সেই অনুযায়ী আমরা প্রাথমিকভাবে একটি প্রকল্প হাতে নিই। বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে জানালে তিনি আমাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। সেই অনুযায়ী পুরো কেরাণীগঞ্জকে ২০০টি সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা হয়। এক্ষেত্রে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার একটি বাজেট ধরা হয়। কেরাণীগঞ্জে আমাদের আওতায় মোট পাঁচটি ইউনিয়নকে চারটি জোনে ভাগ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই সিসি ক্যামেরাগুলো স্থাপন করা হবে।
তিনি বলেন, নির্ধারিত এলাকাগুলোতে মাদক কেনাবেচার একটি হাব রয়েছে। ব্যবসায়ী এলাকা হওয়ায় ছিনতাই, চুরি এবং ডাকাতির ঘটনাও প্রায়শই ঘটে থাকে। তাই এই পুরো এলাকাকে নিরাপদ রাখতে সিসি ক্যামেরাগুলোর মাধ্যমে নজরদারি করতে আমাদের খুব সুবিধা হবে। তাছাড়া কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলে সিসি ক্যামেরা দেখে অপরাধীদের চিহ্নিত করাও অনেক সহজ হবে।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পরিস্থিতি ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় এই পরিকল্পনা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, গাড়ি পোড়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকায় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হচ্ছে, এসব ঘটনাও নিয়মিত নজরদারিতে রাখতে পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা দরকার।
জানা গেছে, এ কার্যক্রমে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিচ্ছে থ্রি এস নেটওয়ার্কিং সিস্টেম নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর অভিজাত গুলশান এলাকার নজরদারিতেও প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার কাজ করছে। এ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে কেরাণীগঞ্জের প্রায় অর্ধেক এলাকা নজরদারির আওতায় আসতে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার উপকণ্ঠ কেরাণীগঞ্জে বিপুল জনগোষ্ঠী বসবাস করে। শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠায় এবং রাজধানীর পার্শ্ববর্তী হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই এখানে ঘনবসতি। ফলে এখানে অপরাধপ্রবণতাও বেশি। বিশাল এই এলাকাকে সিসিটিভির মাধ্যমে প্রশাসনের নজরদারির আওতায় আনার যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, এতে অপরাধপ্রবণতা অনেকাংশেই লাঘব হবে।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ঢাকার নিকটবর্তী এলাকার মধ্যে কেরাণীগঞ্জ সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ এলাকা। এখানে অনেক সময় বেওয়ারিশ মরদেহ পাওয়া যায়; অর্থাৎ অপরাধীরা বিভিন্ন স্থানে খুন করে নিরাপদ এলাকা মনে করে মরদেহ এখানে ফেলে যায়। বিশেষ করে শুভাঢ্যা, জিনজিরা, কোন্ডা, তেঘরিয়া- অপরাধপ্রবণতা বেশি এমন স্থানে সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।