আবু গারিব, ইরাকের একটি কুখ্যাত কারাগার। রাজধানী বাগদাদের নিকটবর্তী এই নামে একটি শহর রয়েছে। সেখানেই অবস্থতি কারাগারটি।
ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বহু বছর ধরে ভিন্নমতাবলম্বী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অবৈধভাবে বন্দি ও নিপীড়নের জন্য কারাগারটি ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে যুদ্ধের সময় কারাগারটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় আমেরিকা। এরপর থেকে আমেরিকাও সেখানে একই কাজ শুরু করে।
২০০৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ইরাক যুদ্ধের প্রধান কুশীলব মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের নির্বাচনী প্রচারণার সময় আবু গারিব কারাগারে নির্যাতনের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় উঠে আসে। মার্কিন সেনাদেরই তোলা বন্দি নির্যাতনের কিছু ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে যায়। মূলত এরপরই বুশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হয়।
বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
সংস্থাটি বলেছে, আবু গারিব এবং ইরাকের অন্যান্য আমেরিকার পরিচালিত কারাগারে মার্কিন বাহিনী কর্তৃক বন্দিদের নির্যাতনের প্রমাণ প্রকাশের পর দুই দশক পরও ওইসব নিরীহ, নিরপরাধ ইরাকিদের ক্ষতিপূরণ বা অন্যান্য প্রতিকার দিতে দৃশ্যত ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ।
ইরাকে আগ্রাসন শুরুর পর আমেরিকা ও তার মিত্ররা ২০০৩ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে প্রায় এক লাখ ইরাকিকে কারাগারে আটকে রাখে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা ইরাকে মার্কিন বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রমাণ নথিভুক্ত করেছে। নির্যাতন থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা তাদের চিকিৎসা ব্যয় পেতে বছরের পর বছর ধর্না দিয়েছেন। কিন্তু মার্কিন সরকারের কাছ থেকে তারা খুব সামান্যই স্বীকৃতি পেয়েছেন। অথচ মার্কিন অভ্যন্তরীণ আইন, ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কনভেনশন, সেইসাথে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের অনুযায়ীও নির্যাতনের ব্যাপারে বিধিনিষেধ সুস্পষ্ট।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়াশিংটন ডিরেক্টর সারাহ ইয়াগার বলেছেন, “বিশ বছর পর, মার্কিন সেনা দ্বারা নির্যাতিত ইরাকিদের কাছে এখনও ক্ষতিপূরণ দাবি বা মার্কিন সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের প্রতিকার বা স্বীকৃতি পাওয়ার কোনো সুস্পষ্ট উপায় দেখা যাচ্ছে না।”
চলতি বছরের এপ্রিল এবং জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে আবু গারিব কারাগারে নির্যাতনের শিকার তালেব আল-মাজলির সাক্ষাতকার নেয় এইচআরডব্লিউ। এছাড়াও তালেবের বন্দিদশা এবং মুক্তি সম্পর্কে জানে এমন তিনজন ব্যক্তি (যারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) তাদেরও সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। একই সঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০০৩ সালে বাগদাদে দায়িত্ব পালন করা একজন সাবেক মার্কিন বিচারক, ইরাকের মানবাধিকারের জন্য হাই কমিশনের প্রাক্তন সদস্য এবং নির্যাতন নিয়ে কাজ করা তিনটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিডিয়া এবং বেসরকারি প্রতিবেদনগুলোও পর্যালোচনা করেছে, সেইসাথে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের কথিত বন্দি নির্যাতনের তদন্তসহ মার্কিন সরকারের নথিগুলোও পর্যালোচনা করেছে।
মে মাসে তালেব আল-মাজলি হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, মার্কিন বাহিনী তাকে নভেম্বর ২০০৩ থেকে মার্চ ২০০৫ এর মধ্যে আবু গারিব কারাগারে আটক রাখার সময় শারীরিক, মানসিক এবং যৌন অবমাননাসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করেছে।
তিনি বলেন, গারিব নিয়ে ভাইরাল হওয়া সেই ছবির পুরুষদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। যেখানে দেখা যায়- একদল নগ্ন বন্দী দিয়ে একটি মানব পিরামিড বানানো হয়। আর দুই মার্কিন সেনা পিছনে দাঁড়িয়ে হাসছে।”
তিনি বলেন, “দু’জন আমেরিকান সৈন্য- যাদের একজন পুরুষ এবং একজন নারী, আমাদের নগ্ন হওয়ার নির্দেশ দেন। তারা আমাদেরকে একজনের ওপর আরেকজনকে উঠার নির্দেশ দেন। আমিও তাদের মধ্যে একজন ছিলাম।”
তালেব আল-মাজলি বলেন, ২০০৩ সালে আনবার প্রদেশে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে গেলে মার্কিন বাহিনী তাকে আটক করে।
তালেব আল মাজলি বলেন, “৩১ অক্টোবর, ২০০৩ সকালে মার্কিন বাহিনী আমার চাচা যে গ্রামে থাকতেন তা ঘিরে ফেলে। তারা গ্রামের ছেলে-বুড়া সবাইকে ধরে নিয়ে যায়। আমি তাদের বলেছিলাম আমি একজন অতিথি। আমি বাগদাদে থাকি এবং আমার চাচার সাথে দেখা করতে এসেছি। তারা আমার মাথা একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় এবং প্লাস্টিকের জিপ টাই দিয়ে আমার কব্জি বেঁধে রাখে। তারা গাড়িতে করে নিয়ে যায়।”
হাব্বানিয়া সামরিক ঘাঁটিতে এবং ইরাকের একটি অজানা স্থানে কয়েকদিন থাকার পর, মার্কিন বাহিনী তালেব আল-মাজলিকে আবু গারিব কারাগারে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, “তখনই শুরু হয় নির্যাতন। তারা আমাদের জামাকাপড় কেড়ে নেয়। যখন আমরা আমাদের মাথার হুড দিয়ে চোখ ঢেকে রাখতাম, তারা আমাদের নিয়ে প্রতিনিয়ত উপহাস করতো। আমরা নিরুপায় ছিলাম।
তিনি বলেন, “পুলিশ কুকুর, সাউন্ড বোমা, গুলি এবং পানির হোস দিয়ে আমাকে নির্যাতন করা হয়েছে।”
যদিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তালেব আল-মাজলির বক্তব্য চূড়ান্তভাবে যাচাই করতে পারেনি। তিনি আসলেই নির্যাতনের শিকার ওই বন্দীদের দিয়ে তৈরি “মানব পিরামিড” এর ছবিতে ছিলেন কি না, আবু গারিবে তার আটক থাকার বিষয়টি বিশ্বাস্যযোগ্য।
তালেব আল মাজলি তার পূর্ণ নাম, বন্দী নম্বর এবং সেল ব্লক-সহ একটি বন্দীর পরিচয়পত্র প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এগুলো প্রমাণ করে মার্কিন বাহিনী তার ছবি, আইরিস স্ক্যান এবং আঙুলের ছাপ নেওয়ার পরে তাকে আবু গারিব কারাগারে রেখেছিল।
তালেব আল-মাজলি হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে ২০০৩ সালে ইরাকি হাই কমিশন ফর হিউম্যান রাইটস (যা ইরাকে মানবাধিকার রক্ষা ও প্রচারের জন্য একটি সরকারি সংস্থা) থেকে পাওয়া একটি চিঠিও দেখান। এসব প্রমাণ করে তিনি আবু গারিব কারাগারে বন্দী ছিলেন।
২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আগ্রাসনের সময় আবু গারিব কারাগারে হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা এবং শিশুকে আটকে রেখেছিল। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি) দ্বারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের কাছে ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আইসিআরসি-কে বলেন- ২০০৩ সালে ইরাকে জোটের হেফাজতে থাকা আনুমানিক ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষকে ভুল বশত গ্রেফতার করা হয়েছিল।
তালেব আল-মাজলি বলেন, আবু গারিব কারাগারে ১৬ মাস থাকার পর তাকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয়। যদিও তিনি মুক্তি পেয়েছেন, তবে বর্তমানে শারীরিকভাবে অসুস্থ। এছাড়াও তিনি বর্তমানে অসহায় এবং মানসিক আঘাতগ্রস্থ। এখনও তিনি সেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
দুই দশক ধরেই তালেব আল-মাজলি ক্ষতিপূরণ চেয়ে আসছেন। একজন আইনজীবী বা বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে ঢেকার সামর্থ্য না থাকায় তিনি ইরাকি বার অ্যাসোসিয়েশনের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাকে ফিরিয়ে দেয়। তারা জানিয়ে দেন যে, এ ধরনের মামলা তারা পরিচালনা করেন না।
এরপর তালেব আল-মাজলি ইরাকি হাই কমিশন ফর হিউম্যান রাইটসে যান। কিন্তু এই সংস্থাটি যা করতে পারে তা হল তাকে একটি চিঠি দিয়ে শুধু নিশ্চিত করতে পার যে- তিনি আবু গারিব কারাগারের একজন প্রাক্তন বন্দী হিসেবে তাদের রেকর্ডে রয়েছে। তালেব আল মাজলি জানান, কীভাবে মার্কিন সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে তা তিনি জানেন না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চলতি বছরের ৬ জুন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগকে একটি চিঠি লেখে। তাতে তালেব আল-মাজলির মামলার বিষয়, গবেষণার ফলাফলগুলো সরবরাহ করে এবং ইরাকে নির্যাতনের পর বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের তথ্যের জন্য অনুরোধ করা হয়। বারবার ফলো-আপ অনুরোধ সত্ত্বেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের কাছে থেকে কোনও সাড়া পায়নি। সূত্র: এইচআরডব্লিউ