করোনা মহামারীর পর ইউক্রেন যুদ্ধ। এর জেরে গত কয়েক বছর ধরেই দফায় দফায় তেলের উৎপাদন হ্রাস করেছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ১৩–দেশীয় জোট অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (ওপেক) ও এর ১০ মিত্রদেশ।
শেষবার চলতি বছরের এপ্রিলে বিস্ময়করভাবে দিনে ২০ লাখ ব্যারেল বাধ্যতামূলক ও আরও ১৬ লাখ ব্যারেল তেল স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে হ্রাসের সিদ্ধান্ত নেয় ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো। অর্থাৎ ২০ লাখ ব্যারেল উৎপাদন অবশ্যই কমানো হবে, সেই সঙ্গে সহযোগী দেশগুলো চাইলে দিনে আরও ১৬ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমাতে পারে- এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কিন্তু সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আর একমত হতে পারছে না ওপেক এর সদস্য দেশ ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত’। গত মাসে আরব আমিরাত ঘোষণা করেছে, তারা সৌদি আরবের সাথে স্বেচ্ছায় বা স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে তেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্তে আর থাকছে না। দেশটির দাবি, সৌদি আরব বাজারের ভারসাম্য বজায় রাখতে উৎপাদন হ্রাসের যে পদক্ষেপ এতদিন নিয়েছে তা যথেষ্ট হয়েছে।
এর পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাত আরও যুক্তি দিয়ে বলছে, ওপেকের বর্তমান কোটার চেয়ে তাদেরকে আরও বেশি তেল উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া উচিত। কিন্তু সংস্থাটির তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদক আরব আমিরাত শুধুমাত্র কোটা অনুযায়ী উৎপাদন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। তাই আমিরাত পর্যায়ক্রমে উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ওপেকের কাছে থেকে বড় ধরনের ছাড় পেয়েছে। এক্ষেত্রে তারা ২০২৪ সালে দৈনিক উৎপাদন বৃদ্ধি দুই লাখ ব্যারেল থেকে বাড়িয়ে ৩.২ মিলিয়ন ব্যারেলে নিয়ে যাবে।
তবে আরব আমিরাতকে তার বুদ্ধিমত্তার পুরষ্কার পেতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। সৌদি আরব প্রতিদিন এক মিলিয়ন ব্যারেল স্বেচ্ছায় কমানো শুরু করার পর থেকে বিশ্ববাজারে তেলের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। বাস্তবতা হল, এক্ষেত্রে সৌদি আরব বড় পদক্ষেপ নিচ্ছে, আর বেশি লাভবান হচ্ছে আরব আমিরাত।
সংযুক্ত আরব আমিরাত পরিকল্পনা করছে, অপরিশোধিত তেল উৎপাদন সক্ষমতা ২০২৭ সালের মধ্যে প্রতিদিন পাঁচ মিলিয়ন ব্যারেলে উন্নীত করার, যা ওপেকের দৈনিক তিন মিলিয়ন ব্যারেল কোটার অনেক উপরে।
ডাটা বিশ্লেষণ সংস্থা ‘কেপলার’ এর অপরিশোধিত তেল বিশ্লেষণ বিভাগের প্রধান ভিক্টর কাটোনা ‘মিডল ইস্ট আই’কে বলেন, “সৌদি আরব ব্যাপকভাবে উৎপাদন হ্রাস করছে। অন্তত রাশিয়া বলছে যে, দেশটি উৎপাদন কমাচ্ছে। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত উৎপাদন হ্রাস করেছে কোটা অনুযায়ী সর্বনিম্ন। শেষ ফলাফল হল- সৌদি আরব সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, আর লাভবান হচ্ছে আরব আমিরাত। দেশটি তেলের দাম এক মাস আগের তুলনায় বর্তমানে ১৫ শতাংশ বেশি পাচ্ছে। সুতরাং যেভাবেই হোক এই গ্রীষ্মে সবচেয়ে বড় বিজয়ী আরব আমিরাত।”
পরিস্থিতি আরও বিদ্রূপাত্মক বলে মনে হয়, যখন দেখবেন মাথাপিছু আয় বিবেচনায় সংযুক্ত আরব আমিরাত সৌদি আরবের চেয়ে অনেক বেশি ধনী। অর্থাৎ সৌদি আরব স্বল্পমেয়াদী দাম নিয়ে বেশি চিন্তিত, যা সরকারি ব্যয়ের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমান উৎপাদন হারে, সৌদি আরবের ভারসাম্য ঠিক রাখতে প্রয়োজন অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার দাম ওঠা।
আরও উৎপাদন কমাবে সৌদি আরব?
সৌদি আরব তেলের দাম বাড়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে উৎপাদন আরও কমানোর সিদ্ধান্ত নিলে আরেকবার লাভবান হবে আরব আমিরাত। দেশটির রাজস্ব আরও একবার লাফ দেবে।
গত মাসে কয়েকজন পণ্য বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন যে, সৌদি ও তার মিত্ররা স্বেচ্ছামূলক উৎপাদন কমানো দীর্ঘায়িত করবে। তবে সেপ্টেম্বরে উৎপাদন হ্রাস দৈনিক আড়াই লাখ থেকে পাঁচ লাখ ব্যারেল কমিয়ে দিয়ে তাতে ভারসাম্য আনবে। কিন্তু এক সপ্তাহ পর সৌদি প্রেস এজেন্সি নিশ্চিত করেছে, দেশটি প্রকৃতপক্ষে সেপ্টেম্বরে দৈনিক এক মিলিয়ন ব্যারেল তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেবে। কিন্তু এখানে একটি সূক্ষ্ণ বিষয় বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে আসেনি। তারা বলেছে, ‘উৎপাদন হ্রাস দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে’। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রথমবারের মতো সৌদি আরব বলল- যদি পূর্ববর্তী পদক্ষেপগুলো কাঙ্ক্ষিত প্রভাব অর্জনে খুব বেশি সময় নেয়, সেক্ষেত্রে তেলের উৎপাদনে আরও কাটছাঁট করা হবে।
তেলের বড় বা প্রধান গ্রাহকদের দুর্বল চাহিদা সৌদি আরবকে আরও উৎপাদন কমাতে উৎসাহিত করাতে পারে। চীন থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশটি অপরিশোধিত তেল আমদানি দৈনিক ২.৪১২ মিলিয়ন ব্যারেল কমিয়েছে। বর্তমানে দেশটি দৈনিক ১০.৪২৯ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি করছে, যা বিগত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এটা স্পষ্ট নয় যে, জুনের দেশটির আমদানি রেকর্ডে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হওয়ায়, এটি একটি নিম্নমুখী প্রবণতার সূচনা কিনা। সত্যি বলতে, জুলাই মাসে অপরিশোধিত তেল আমদানির বাৎসরিক বৃদ্ধি ছিল দৈনিক ১.৫১৯ মিলিয়ন ব্যারেল, যা এক বছর আগের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি।
এদিকে, জুলাই মাসে ভারতের দৈনিক তেলের চাহিদা ছিল ৪.৭০ মিলিয়ন ব্যারেল, যা ওয়াল স্ট্রিটের প্রত্যাশার চেয়ে দৈনিক ৪.৮৩ মিলিয়ন ব্যারেল কম। জুনে দেশটির বাৎসরিক চাহিদা বিবেচনায়, দৈনিক চাহিদা বেড়ে দাড়িয়েছিল ১৯০ হাজার ব্যারেলে। যা জুলাই মাসে কমে দৈনিক ৮৪ হাজার ব্যারেলে নেমে এসেছে। এখানেও মিশ্র উপাত্ত পাওয়া গেছে। কেননা, দেশটিতে পেট্রলের চাহিদা জুনে ৬.২ শতাংশ থেকে বেড়ে জুলাই মাসে ৬.৩ হয়েছে এবং ডিজেলের চাহিদা বেড়ে ৩.১ শতাংশ থেকে ৩.৯ শতাংশ হয়েছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের পণ্য বিশ্লেষকদের ধারণা, সৌদি আরব তেলের উৎপাদন আর কমাবে না। কারণ অপরিশোধিত তেলের মজুতকারীর সংখ্যা সামনে দ্রুত হ্রাস পেতে পারে। বেশিরভাগ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন, বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারগুলো ধীরে ধীরে শক্তিশালী হবে, যা মাস এবং ত্রৈমাসিক হিসেবে দাম বাড়াতে পারে। প্যারিসের আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) বছরের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিদিন প্রায় ১.৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেলের ঘাটতির পূর্বাভাস দিয়েছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের কমোডিটি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বব্যাপী তেলের বাজার আগস্টে প্রতিদিন ২.৮১ মিলিয়ন ব্যারেল সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেবে। সেপ্টেম্বরে ঘাটতি থাকবে দৈনিক ২.৪৩ মিলিয়ন ব্যারেল আর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তা দৈনিক ২ মিলিয়ন ব্যারেলে গিয়ে উপনীত হবে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক মজুতের চাহিদা ৩১০ ব্যারেল কমে যাবে এবং ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে তা আরও ৯৪ মিলিয়ন ব্যারেল কমবে। এইভাবে তেলের দাম আরও বেশি হবে। স্ট্যানচার্টের মতে, চতুর্থ ত্রৈমাসিকে ব্রেন্টের দাম ব্যারেল প্রতি ৯৩ ডলারে উঠবে। সূত্র: ওয়েল প্রাইস