বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে পরিচ্ছন্ন ফল ও সবজির সংকটে পড়েছে ব্রিটেন। দেশটির সর্বত্র নাগরিকদের একসঙ্গে বেশি পরিমাণ সবজি কিনতে বারণ করা হচ্ছে।
বড় বড় সুপারশপে দেখা দিয়েছে টমেটোসহ সালাদ তৈরির বিভিন্ন সামগ্রীর সংকট। কয়েক সপ্তাহ ধরেই এ সংকট চলমান। কোথাও সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যেমন ভোক্তার জন্য সবজি কেনার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া, অধিক পরিমাণে সবজি কিনতে না দেওয়া ইত্যাদি।
অন্যদিকে, লেটুস, সালাদ ব্যাগ, ব্রকোলি, ফুলকপি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে আসদা। মরিসন মাত্র দুটি করে টমেটো, শসা, লেটুস ও গোলমরিচ কেনার অনুমতি দিচ্ছে।
দেশটির সরকার বলছে, এসব সবজির মূল সরবরাহকারী স্পেন ও উত্তর আফ্রিকায় খারাপ আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। যে কারণে হঠাৎ করেই অতি প্রয়োজনীয় এসব সবজির সংকট দেখা দিয়েছে।
যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, কেবল সরবরাহ সংকট নয় ব্রিটেনভিত্তিক কিছু কারণেও এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হল জ্বালানির দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া। জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে ব্রিটেনের কৃষকরা সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ সবজি চাষ করতে পারেননি। যদিও সরকার কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে, সুপারমার্কেটের দাম নির্ধারণেও ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় সেসব কাজে আসেনি। বাজারে তাজা সবজির সংকট ঠিকই দেখা দিয়েছে।
ব্রিটেনের ভোক্তারা বছরে পাঁচ লাখ টন টমেটো খেয়ে থাকেন। এর এক-পঞ্চমাংশ বা এক লাখ টন উৎপাদন করেন স্থানীয় চাষীরা। অর্থাৎ চাহিদার বড় অংশই আমদানি করতে হয়। সর্বশেষ মৌসুমে স্থানীয় উৎপাদন তো কম হয়েছেই, আমদানিও কমেছে। যে কারণে এ সংকটের মুখে পড়েছে দেশটির টমেটোর বাজার।
প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্য মানুষ সুপারমার্কেটের খালি সবজির ঝুড়ির ছবি দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য দেশের বাজার যে তাজা সবজিতে সয়লাব তার ছবিও দেয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে তুলনাও করা হচ্ছে। আর সবজির এ সংকটের জন্য ব্রেক্সিটকেও দায়ী করছেন সাধারণ ব্রিটেনবাসী।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠতে পারে, ইউরোপের অন্যান্য দেশে কোথা থেকে সবজির সরবরাহ হয়? ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, জোটের দেশগুলোতেও স্পেন থেকে সবজি আসে। তবে সে সরবরাহে এখন ধীরগতি দেখা দিয়েছে। ইইউর কৃষিবাজারে সবজি সংকট হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। সরবরাহে কিছুটা ধীরগতির কারণ হল ডিসেম্বর পর্যন্ত গত গ্রীষ্মে তাপমাত্রা বেশ উচ্চ ছিল। জানুয়ারিতে গিয়ে হুট করেই তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। মূলত তাপমাত্রার এ তারতম্যই ফলনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যার কারণে উৎপাদন কমেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়েছে সরবরাহে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আয়ারল্যান্ডে কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে। এজন্য দেশটির বিক্রেতারা দায়ী করছেন দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর নিম্ন তাপমাত্রা। কিন্তু এখনও সেখানে ফল ও সবজি বিক্রির ওপর সীমারেখা টেনে দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ব্রেক্সিট কীভাবে ইইউ থেকে টমেটো আমদানিতে প্রভাব ফেলছে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো একটি একক বাজারের অন্তর্ভুক্ত। এখানে দেশগুলোর মতো কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুনের ভিত্তিতে মুক্ত বাণিজ্য চলে। কিন্তু ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্য আর সেই বাজারের অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে তার জন্য আমদানি নীতিও বদলে গেছে। যেমন টমেটোর মতো উদ্ভিজ্জ পণ্য ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে যুক্তরাজ্যে পাঠাতে হলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ঘোষণা প্রয়োজন। আবার সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগকেও আগে থেকে জানাতে হবে। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট নীতিমালা করা আছে। সে অনুযায়ীই টমেটোর মতো পণ্য আমদানি বা রফতানি করতে হবে। জটিল এ প্রক্রিয়াও আমদানিতে সংকট সৃষ্টির কারণ।
এসব নিয়মনীতি-সংক্রান্ত কাজ করে দেয় এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। এমসিই লজিস্টিকস নামে ওই প্রতিষ্ঠান স্পেন থেকে ব্রিটেনে টমেটো আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, টমেটোবাহী প্রতিটি লরির জন্য কাগজপত্র তৈরি করতে ১০-২০ মিনিট সময় লাগে। আবার যদি কোনও আমদানিকারক কয়েক ধরনের ফল-সবজি আমদানি করেন তখন এসব কাজ করতে সময় আরও বেশি লেগে যায়। আমদানিসংক্রান্ত এসব তথ্য সন্নিবেশের জন্য আলাদা বিশেষায়িত সফটওয়্যার আছে।
ব্রেক্সিটের পর সৃষ্টি হওয়া নিয়মকানুন, কাগজপত্র পূরণের কারণে সবজির বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক আমদানিকারক। স্পেনের সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, ব্রেক্সিটের পর থেকে ব্রিটেনের বাজারে স্পেনের ফল-সবজি সরবরাহ করা এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মতো হয়ে গেছে। তবে চলমান টমেটো সংকট ব্রেক্সিটের কারণ নয়, বরং আবহাওয়ার কারণে সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানিয়েছেন স্পেন সরকারের এক মুখপাত্র। সূত্র: বিবিসি