শরণার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার অভিযোগে বিতর্কের মুখে পড়েছে কানাডার লিবারেল সরকার। বিল সি-১২ নামে নতুন একটি আইন প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে মানবাধিকারকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন-এটি কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠোর ও দমনমূলক সীমান্ত নীতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
‘স্ট্রেংথেনিং কানাডা’স ইমিগ্রেশন সিস্টেম অ্যান্ড বর্ডার্স অ্যাক্ট’ নামে পরিচিত এই বিলটিতে সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি শরণার্থী দাবির যোগ্যতা নির্ধারণে কড়াকড়ি আরোপের প্রস্তাব রয়েছে।
সংসদীয় ছুটির আগে গত ১১ ডিসেম্বর হাউস অব কমন্সে দ্রুতগতিতে তৃতীয় পাঠে পাস হয় বিলটি। আগামী ফেব্রুয়ারিতে সিনেটের অনুমোদন পেলে এটি আইনে পরিণত হবে।
টরন্টো মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির শরণার্থী ও মানবাধিকার আইনের অধ্যাপক ইদিল আতাক বলেন, “শরণার্থী সুরক্ষার দিক থেকে এই আইনটি অত্যন্ত পশ্চাৎমুখী।”
তিনি আরও বলেন, এই আইনের মাধ্যমে সরকার অভূতপূর্বভাবে নির্বাহী ক্ষমতা বাড়াতে চাচ্ছে-যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে শরণার্থীসংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান এবং অভিবাসন নথি বাতিল বা পরিবর্তনের ক্ষমতা।
বিলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা অনুযায়ী, কানাডায় প্রবেশের এক বছরের বেশি সময় পর কেউ আশ্রয়ের আবেদন করলে, সেই আবেদন আর ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি বোর্ডে যাবে না। বরং তা পাঠানো হবে একজন অভিবাসন কর্মকর্তার কাছে প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট (দেশত্যাগের আগের ঝুঁকি মূল্যায়ন) প্রক্রিয়ার জন্য।
আইনজীবীদের মতে, এই প্রক্রিয়ায় আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার অত্যন্ত বেশি এবং এতে শরণার্থীরা ন্যায্য শুনানির সুযোগ পান না।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অড্রি ম্যাকলিন বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই শরণার্থীরা সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয়ের আবেদন করতে পারেন না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যৌন নিপীড়নের শিকার কোনো শিক্ষার্থী কানাডায় মুক্তভাবে বসবাস শুরু করার পর নিজ দেশে ফিরতে অনিরাপদ বোধ করতে পারেন।
২০২৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সংখ্যা কঠোরভাবে সীমিত করায়, ভবিষ্যতে এমন অনেক শিক্ষার্থী আশ্রয়ের আবেদন করতে বাধ্য হতে পারেন-কিন্তু নতুন আইন তাদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
এদিকে টরন্টো স্টার জানিয়েছে, ২০২৪ সালে কানাডা ১৮ হাজার মানুষকে বহিষ্কার করেছে, যা ২০০৬-১৫ সালের পর সর্বোচ্চ। এসব বহিষ্কারে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭৮ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।
বিলের আরেকটি ধারা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা স্থল সীমান্তে ১৪ দিনের বেশি সময় পর আশ্রয়ের আবেদন করলে সেটিও বোর্ডে পাঠানো হবে না।
যদিও কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সেইফ থার্ড কান্ট্রি অ্যাগ্রিমেন্ট রয়েছে, অধ্যাপক ম্যাকলিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই প্রকৃত অর্থে ‘নিরাপদ তৃতীয় দেশ’ ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত বহিষ্কার অভিযান শরণার্থীদের জন্য দেশটিকে আরও অনিরাপদ করে তুলেছে।
মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স অ্যালায়েন্স ফর চেঞ্জ-এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ হুসাইন বলেন, “জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটের জন্য করপোরেট প্রতিষ্ঠান বা বড় ব্যবসার বদলে অভিবাসীদের দায়ী করার রাজনীতি চলছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার চাপের মধ্যেই সীমান্ত ‘নিরাপদ’ দেখানোর চেষ্টা হিসেবে এই আইন আনা হয়েছে।
অধ্যাপক আতাক বলেন, “এর ফলে কানাডার শরণার্থী-বান্ধব ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে সরে আসার ইঙ্গিত মিলছে। শরণার্থীদের সুরক্ষা দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”

