সাধারণ মরুভূমির ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে জলবায়ু, ভূগোল এবং মানবজীবনের আন্তঃসম্পর্ককে নতুন করে বুঝতে হয় ভারতের লাদাখ অঞ্চলকে বোঝার জন্য। লাদাখে শীতকালে পায়ের নিচে তুষারের খসখস শব্দ শোনা যায়, হিমেল বাতাসে নিস্তব্ধতার অনুভূতি তৈরি হয়। চারদিকে পর্বতশ্রেণি ঘিরে থাকে, যাদের চূড়ায় গ্রীষ্মকালেও বরফ জমে। প্রশস্ত উপত্যকার মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে শীতল নদীও। এমন দৃশ্য দেখে মরুভূমির কথা মনে না পড়লেও লাদাখ প্রকৃতপক্ষে মরুভূমি। তবে, তা কোনও উষ্ণ অঞ্চল নয়, বরং এক ঠাণ্ডা শীতল বরফময় মরুভূমি।
শীতল আবহাওয়া, স্বল্প বৃষ্টিপাত এবং বিশাল উচ্চতার কারণে লাদাখ ভারতের সবচেয়ে চরম আবহাওয়ার অঞ্চলের একটি। এখানে বেঁচে থাকা সর্বদা অভিযোজনের ওপর নির্ভর করে। এটি এমন একটি জায়গা যা মরুভূমি কেমন দেখাচ্ছে তার মৌলিক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে।
কেন লাদাখকে ভারতের ঠাণ্ডা মরুভূমি বলা হয়
মরুভূমির সংজ্ঞা তাপমাত্রায় নয়, বৃষ্টিপাতে নির্ভর করে। লাদাখে বৃষ্টিপাত বছরে ১০০ মিলিমিটারেরও কম। হিমালয় পর্বতমালা বর্ষার মেঘকে বাধা দিয়ে লাদাখকে বৃষ্টির ছায়া অঞ্চলে পরিণত করেছে। উচ্চতার কারণে দ্রুত আর্দ্রতা হারিয়ে মাটি থাকে শুকনো এবং অনুর্বর। শীতকালে প্রচুর তুষারপাত হলেও তা স্থায়ী জলের উৎস তৈরি করতে পারে না। ফলে লাদাখে কঠিন শীতের সঙ্গে যুক্ত থাকে তীব্র শুষ্কতা এবং সেই কারণেই এই অঞ্চল ঠান্ডা মরুভূমি হিসেবে পরিচিত।
অন্যান্য মরুভূমি থেকে লাদাখের পার্থক্য ও জীবনের বাস্তবতা
ভারতে মরুভূমি হিসেবে সাধারণত রাজস্থানের থার মরুভূমির নাম উঠে আসে। কিন্তু লাদাখের পরিচয় আলাদা। থার যেখানে বালিয়াড়ি আর উষ্ণতার জন্য পরিচিত, লাদাখ সেখানে পরিচিত তীব্র শীত, উচ্চতা এবং বিচ্ছিন্নতার জন্য। এখানকার প্রাকৃতিক অবস্থা বৈচিত্র্যময় এবং অমসৃণ।
লাদাখে জীবন মানেই কঠিন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। বছরের স্বল্প গ্রীষ্মকালই কৃষিকাজের সময়। অল্প সময়ে ফসল চাষ করে শীতের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। ঘরবাড়ি তৈরি করা হয় পুরু দেওয়ালে, যাতে উষ্ণতা দীর্ঘক্ষণ থাকে। অনেক স্থানে সৌরশক্তির ওপর নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। শীতকালে দীর্ঘ সময় সড়ক বন্ধ থাকায় এলাকাবাসী মিলেমিশে সহযোগিতা করে জীবনযাপন করে। সমাজ ও সংস্কৃতির বন্ধন এখানে মানুষের মানসিক শক্তির অন্যতম উৎস।
ভূগোলের প্রভাব
লাদাখের ভূ-প্রকৃতি এখানকার পরিচিতিকে আরও স্পষ্ট করে। সিন্ধু নদী অঞ্চলজুড়ে প্রবাহিত হয়ে বসতি ও কৃষিকে টিকিয়ে রেখেছে। বিশাল উপত্যকা পর্বতমালার মাঝে বিস্তৃত হয়ে বিশেষ ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্য তৈরি করেছে। এখানেই রয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটরযান চলাচলের কিছু রাস্তা। তবে শীতে এসব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে লাদাখ দেশের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন জনবহুল অঞ্চলে পরিণত হয়।
লাদাখে পৌঁছেই উচ্চতার প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, মাথা ভারী লাগা এবং ধীরগতি অনুভূত হওয়া স্বাভাবিক। নীরবতা এবং প্রকৃতির অতুলনীয় সৌন্দর্য প্রথমেই মনকে আকর্ষণ করে, তবে এই জায়গাকে বুঝতে ধৈর্য, বিশ্রাম ও সময় প্রয়োজন। কারণ, লাদাখ দ্রুত নিজেকে প্রকাশ করে না।
লাদাখের জলবায়ু কেমন
মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রীষ্মে রাস্তা খোলা থাকে, দিনের তাপমাত্রা থাকে ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে, তবে রাত হয় ঠান্ডা। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শীতকালে তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। ভারী তুষারপাতের কারণে রাস্তা বন্ধ থাকে এবং ভ্রমণ হয়ে ওঠে ঝুঁকিপূর্ণ। এপ্রিল ও অক্টোবর মাসে কখনো কখনও আবহাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, পর্যটকও থাকে তুলনামূলক কম।
লাদাখের বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য বিভিন্ন স্থানে ভিন্নভাবে ধরা দেয়। শান্ত পরিবেশ চাইলে প্যাংগং হ্রদ, বৈচিত্র্যের অনুভূতি চাইলে নুব্রা ভ্যালির বালিয়াড়ি আর বরফশৃঙ্গ, উচ্চতার অভিজ্ঞতা নিতে খারদুংলা পাস, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য হেমিস, থিকসে ও ডিসকিট মঠ এবং রোমাঞ্চকর অভিযানের জন্য জমাট ঠাণ্ডা জান্সকার নদীতে রিভার রাফটিং অনন্য।
উচ্চতার কারণে লাদাখে এ্যাকিউট মাউন্টেন সিকনেসের ঝুঁকি থাকে। তাই প্রথম ২৪–৪৮ ঘণ্টা শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। পানি পান, হালকা খাবার গ্রহণ এবং ধীরে ধীরে উঁচু অঞ্চলে ওঠা উপকারী। প্রয়োজনে অক্সিজেন সুবিধা লেহ শহরে পাওয়া যায়।
যেভাবে লাদাখে যাওয়া যায়
লেহ বিমানবন্দর থেকে দিল্লি, মুম্বাই ও শ্রীনগরসহ দেশটির বড় শহরে যাতায়াত করা যায়। সড়কপথে মানালি–লেহ এবং শ্রীনগর–লেহ মহাসড়ক মৌসুমি সময়েই খোলা থাকে। গ্রীষ্মকালে বাস ও শেয়ার ট্যাক্সিও চলে।
মরুভূমির নতুন সংজ্ঞা দেয় লাদাখ
লাদাখ দেখায় যে মরুভূমি মানেই শূন্যতা নয়, আর ঠাণ্ডা মানেই প্রাণহীনতা নয়। তুষারাবৃত পর্বত আর শুষ্ক উপত্যকা এখানে পাশাপাশি অবস্থান করে। প্রকৃতি, মানুষ ও সময়ের সমন্বয় লাদাখকে অনন্য করে তুলেছে। তাই মরুভূমির প্রচলিত সংজ্ঞা নতুন অর্থ পায় লাদাখের ভূখণ্ডে। এটি কেবল ঠাণ্ডা মরুভূমি নয়—এটি প্রকৃতি ও জীবনের এক বিস্ময়কর সত্য। সূত্র: এনডিটিভি

