পাল্লা যখন পাঁচ হাজার পাঁচশো কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়, তখন তা আর সাধারণ কোনো অস্ত্র থাকে না; হয়ে ওঠে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে আঘাত হানতে সক্ষম বিধ্বংসী মারণাস্ত্র। প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএম। বর্তমান বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই প্রযুক্তি কেবল সমরাস্ত্র নয় বরং আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার এক অপরিহার্য স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৫৭ সালের আগস্ট মাসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন বিশ্বের প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় রকেট আর-সেভেন সফলভাবে উৎক্ষেপণ করে, তখন থেকেই বিশ্ব নিরাপত্তার সমীকরণ চিরতরে বদলে যায়। এর মাত্র দুই বছর পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজস্ব আইসিবিএম মোতায়েন করে এবং বর্তমানে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর পারমাণবিক সক্ষমতার মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের কার্যপ্রণালী বেশ বিস্ময়কর। এগুলো সাধারণত রকেটের সাহায্যে উৎক্ষেপণের পর একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে শক্তিহীন অবস্থায় ধনুকের মতো বাঁকানো পথে লক্ষ্যের দিকে ছোটে। একটি আইসিবিএম মূলত তিনটি পর্যায়ে তার যাত্রা সম্পন্ন করে। প্রথমটি হলো বুস্ট ফেজ বা উৎক্ষেপণ পর্যায়, যা বায়ুমণ্ডলের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। এরপর শুরু হয় মিডকোর্স ফেজ, যা যাত্রাপথের দীর্ঘতম অংশ। এই সময়ে ক্ষেপণাস্ত্রটি মহাকাশের বুক চিরে ঘণ্টায় প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার বেগে অগ্রসর হয়। সর্বশেষ পর্যায়টি হলো টার্মিনাল ফেজ, যেখানে ওয়ারহেডটি পুনরায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং প্রচণ্ড গতিতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানে। এই শেষ পর্যায়ের স্থায়িত্ব এক মিনিটেরও কম হলেও এর বিধ্বংসী ক্ষমতা অপরিসীম।
সময়ের সাথে সাথে এই প্রযুক্তিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। আমেরিকার পিসকিপার ক্ষেপণাস্ত্রের মতো উন্নত সংস্করণগুলো এখন একটির পরিবর্তে পৃথক দশটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম, একে প্রযুক্তিগত ভাষায় এমআইআরভি বলা হয়। আবার স্থলভাগের পাশাপাশি জলপথ থেকে আঘাত হানার জন্য ট্রাইডেন্টের মতো সাবমেরিন-লঞ্চড ব্যালিস্টিক মিসাইল বা এসএলবিএম ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যা এই মরণাস্ত্রের কার্যকারিতা ও টিকে থাকার ক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কেবল আক্রমণ নয় বরং একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই এই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বিশ্ব নিরাপত্তার কেন্দ্রীয় আলোচনায় অবস্থান করছে।

