ডেভিড বেকহ্যাম আর লিওনেল মেসি, এখন এক একই সূত্রে গাঁথা। দু’জনেই ফুটবলের উজ্জ্বল তারা। তবে মেসি হচ্ছেন উজ্জ্বলের চেয়েও উজ্জ্বলতম, ফুটবল আকাশের ধ্রুবতারা। আর এই দুই জনের যুগলবন্দিই বদলে দিয়েছে একটা গল্পের গতিপথ। লিখেছে রূপকথা। তাদের ছোঁয়ায় ইন্টার মায়ামিও দ্যুতি ছড়াচ্ছে। কিন্তু কিভাবে ঘটলো এমন অলৌকিক কাণ্ড?
ডেভিড বেকহ্যাম যখন ২০১৩ সালে মেজর লিগ সকারে (এমএলএস) তার পরিকল্পিত ফুটবল দলটির জন্য মায়ামিকে বেছে নিয়েছিলেন, তখন এর পরিণতি কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। ২০০৭ সালে খেলোয়াড় হিসেবে এলএ গ্যালাক্সিতে যোগদানের সময় এমএলএসের সাথে হওয়া একটি আর্থিক চুক্তির অংশ হিসেবে ১৫.৬ মিলিয়ন পাউন্ডে ফ্র্যাঞ্চাইজিটি কিনে নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক। ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাবটি চালু হয় এবং ২০২০ সালের মার্চ মাসে তারা এমএলএসে আত্মপ্রকাশ করে।
এরপর ২০২৩ সালে তর্কসাপেক্ষে বিশ্বের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসিকে সই করানোর পর ইন্টার মায়ামি এখন লিগের সবচেয়ে বড় শিরোপা জেতার দোরগোড়ায়। শনিবার এমএলএস কাপ ফাইনালে তারা থমাস মুলারের ভ্যাঙ্কুভার হোয়াইটক্যাপসের মুখোমুখি হবে।
এই সফলতা বেকহ্যামের প্রজেক্ট বেকহ্যামের মাঠে ও মাঠের বাইরে দ্রুত উত্থানের স্মারক। মায়ামি আমেরিকাজুড়ে ফুটবলের প্রতি আগ্রহের এক বিশাল ঢেউ এনে দিয়েছে।
ক্লাবটির চিফ বিজনেস অফিসার জাভি আসেনসি সহ-মালিক বেকহ্যামের ভূমিকাকে অবিশ্বাস্য বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ডেভিড বেকহ্যাম না থাকলে আজ আমরা কেউই এখানে বসতাম না। তবে সবকিছু শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে। ডেভিড বেকহ্যাম ও লিওনেল মেসির মতো বিশ্বজোড়া পরিচিত নাম আর নেই, তাঁরা এখানে এক হয়েছেন।
বার্সেলোনায় দশ বছর চিফ কমার্শিয়াল অফিসার এবং এক্সিকিউটিভ বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করার পর ৪৩ বছর বয়সী আসেনসি ২০২১ সালের এপ্রিলে ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেন। তিনি জানান, ২০২০-২১ সালে যখন মালিক জর্জ মাস, হোসে মাস এবং ডেভিড বেকহ্যামের নেতৃত্বে আমরা এখানে আসি, তখন প্রধান লক্ষ্য ছিল মাঠের খেলায় জয়লাভ করা। মেসির প্রশংসা করে তিনি বলেন, লিওনেল মেসি সর্বকালের সেরা। তাই আপনার দলে সেরা খেলোয়াড়কে রাখাটা কোনো চিন্তা না করেই করার মতো কাজ।
২০২৩ সালের ৭ জুন কয়েক সপ্তাহ জল্পনা চলার পর ইন্টার মায়ামি আনুষ্ঠানিকভাবে মেসির সাথে চুক্তির ঘোষণা করে। মাত্র দুই মৌসুম পিএসজিতে কাটানোর পর এই আর্জেন্টাইন তারকা মায়ামি ও এমএলএসের চ্যালেঞ্জ বেছে নেন। চুক্তির খবরে জাপানে থাকা বেকহ্যাম নোটিফিকেশনের বন্যা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন।
আসেনসি স্মরণ করেন, এক রাতের মধ্যে আমরা শুধু একটি এমএলএস ক্লাব থেকে এমন একটি ক্লাবে পরিণত হয়েছি, যাকে আমি বলব সবাই চেনে। ফিজি থেকে অ্যাঙ্কোরেজ, প্যাটাগোনিয়া থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিশ্বের প্রতিটি আউটলেট এই নিয়ে কথা বলেছে। এটা ইন্টার মায়ামিকে বড় মঞ্চে তুলে দিয়েছে।
মায়ামিতে মেসি তার পুরনো বার্সা সতীর্থ জর্দি আলবা, সার্জিও বুসকেতস এবং পরে লুইস সুয়ারেজ এবং কোচ জেরার্ডো মার্টিনোর সঙ্গে পুনরায় মাঠে নামেন। তিনি তার চুক্তি বাড়িয়ে ২০২৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইন্টার মায়ামিতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মেসির আগমনের পর এমএলএস হঠাৎ করেই বিশ্ব ফুটবল আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। প্রায় প্রতিটি ইন্টার মায়ামি ম্যাচের টিকিট মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে যায়। তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার উপস্থিতি প্রায় ২ মিলিয়ন থেকে ৫০ মিলিয়নে পৌঁছেছে। মেসির অভিষেকের পর গড় এমএলএসে দর্শকের সংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে প্রথম ১০টি ম্যাচের সময় বিশ্বব্যাপী স্ট্রিমিং হয় দ্বিগুণ।
মেসির কারণে টিকিটের দামও আকাশ ছুঁয়েছে। মেসি আসার আগে টিকিটের দাম ছিল প্রায় ৪০ পাউন্ড, আর আজ মায়ামির খেলা দেখতে খরচ হয় ১৫০ থেকে ২০০ পাউন্ডের মধ্যে। ইন্টার মায়ামি ও মেসিকে আতিথ্য দেওয়া দলগুলো টিকিটের চাহিদা মেটাতে তাদের ঘরের মাঠ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
২০২২ সালে ক্লাবের বার্ষিক আয় ছিল ৪১ মিলিয়ন পাউন্ড। ২০২৪ সালে তা বেড়ে ১৬০ মিলিয়ন পাউন্ড হয়েছে। মেসির প্রভাব লিগকে ২০২৩-২৪ মৌসুমে ১১.৪ মিলিয়নেরও বেশি দর্শকের রেকর্ড উপস্থিতিতে পৌঁছে দিয়েছে। মেসির অভিষেকের ফলে অ্যাপল টিভিতে এমএলএস সিজন পাসের সাবস্ক্রাইবার ৩ লক্ষ বেড়েছে।
আসেনসি বলেন, লিওকে কেউ প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। এমন কেউ আসবে না যে এই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে। আমরা সেই ঐতিহ্য তৈরি করার চেষ্টা করছি যাতে অন্যান্য ভালো খেলোয়াড়দের জন্য আমরা টেনে আনতে পারি।
ক্রীড়া আইকন, পপ সেলিব্রিটি এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালীদের নিয়মিত উপস্থিতি ইন্টার মায়ামিকে সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে।
বেকহ্যাম দ্রুত উপলব্ধি করেছিলেন যে মায়ামির দৃশ্যমান পরিচয়ে গোলাপী রং কতটা গভীরভাবে মিশে আছে। প্রথমে প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি বিশ্বাস করতেন গোলাপীই হওয়া উচিত ইন্টার মায়ামির নির্দিষ্ট রং। শেষ পর্যন্ত তিনি সেই যুক্তি জিতেছিলেন।
তাদের নতুন স্টেডিয়াম, মায়ামি ফ্রিডম পার্কের নির্মাণ কাজও প্রায় শেষ হতে চলেছে। ইন্টার মায়ামি ২০২৬ সালের বেশিরভাগ এমএলএস ম্যাচ এই স্টেডিয়ামে খেলবে। নতুন স্টেডিয়ামের মাধ্যমে ক্লাবের বাজেট এই মৌসুমের ১৬০ মিলিয়ন পাউন্ড ($২১৫ মিলিয়ন) থেকে ২৫০ মিলিয়ন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আসেনসি উপসংহারে বলেন, সব মিলিয়ে আমি বলব এটি একটি অলৌকিক ঘটনা। এটি একটি চমৎকার অলৌকিক ঘটনা; এটি দুঃসাহসী গল্প এবং স্বপ্ন। লিও আমাদের হয়ে খেলছে এবং আমাদের অধিনায়ক হওয়াতে সবকিছু আমূল পাল্টে গেছে।
সূত্র: বিবিসি

