জনমতের সঠিক প্রতিফলন না ঘটার আশঙ্কা

0
জনমতের সঠিক প্রতিফলন না ঘটার আশঙ্কা

জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশে যেভাবে গণভোটের কথা বলা হয়েছে তাতে জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে না বলে সংশয় প্রকাশ করছেন নির্বাচন ও আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, যে চার প্রস্তাব বা প্রশ্নে গণভোট হতে যাচ্ছে তা দেশের সাধারণ মানুষের জানা-বোঝার বাইরে। ভোটারদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হলে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া যে নজিরবিহীনভাবে এই আদেশ জারি করা হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে বিষয়টি আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।

নির্বাচন কমিশন আগামীকাল রবিবার এ বিষয়ে তাদের করণীয় নির্ধারণে বৈঠকে বসতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বাম দলগুলো মনে করছে, গণভোটের চেয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, জাতীয় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে যেভাবে যেসব প্রস্তাবে গণভোটের আয়োজনের কথা বলা হয়েছে তার জন্য ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।

তিনি গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘বেশির ভাগ মানুষের জন্য এই মুহূর্তে সরকারের করণীয় একটাই, ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে জনগণকে বিষয়টি বোঝাতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। মানুষ যদি বুঝতে না পারে তাহলে আমার ধারণা, অনেকেই এই ভোটে অংশগ্রহণ করবে না।
ব্যালট দুটি থাকবে। একটি সংসদ নির্বাচনের ব্যালট, অন্যটি গণভোটের। সংসদ নির্বাচনের ব্যালটে পছন্দের মার্কায় ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা ভোটারদের আছে বা নতুন ভোটারদেরও এ বিষয়ে ধারণা আছে। কিন্তু গণভোটের বিষয়টিতে সে রকম সচেতনতা নেই। সে ক্ষেত্রে কিভাবে ভোট দিতে হবে, এর প্রস্তাব বা প্রশ্নগুলো কী, সে সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি দরকার।’
ড. শাহদীন মালিক আরো বলেন, ‘আইনের ব্যাকরণ অনুসারে জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। এরই মধ্যে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ যদি আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনে বাতিল করে দেওয়া হয় তাহলে কী হবে। সংসদ তো সার্বভৌম। রাষ্ট্রপতির আদেশ অধ্যাদেশ বাতিলের ক্ষমতা তো সংসদের আছে। যা হচ্ছে তা আইনের বাইরে থেকে হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ নিয়ে অনেক প্রশ্নের সমাধান করতে হতে পারে। যেভাবে গণভোট হতে যাচ্ছে তাতে বুঝেশুনে মতামত হবে না। তার পরও জনগণকে যতটা বোঝানোর চেষ্টা করা যায় করতে হবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ আদেশ যেভাবে জারি হয়েছে এর নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। বিদ্যমান সংবিধান অনুসারে এ ধরনের আদেশ জারির এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির নেই।’

গণভোটে মতামত জানানোর বিষয়টি সহজসাধ্য হবে না এবং জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে না বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য বেগম জেসমিন টুলি।

তিনি ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে দুটি গণভোটে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, ‘ওই সময় প্রশ্নগুলো এবারের মতো এত জটিল ছিল না। তার পরও আগের ওই দুটি গণভোটে, বিশেষ করে ১৯৮৫ সালের গণভোটে জনমতের চেয়ে ক্ষমতাসীন পক্ষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করা হয়।’

১৯৮৫ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ওই বছরের ২১ মার্চ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে ভোটারদের কাছে প্রশ্ন ছিল আপনি কি রাষ্ট্রপতি এরশাদের গৃহীত নীতি সমর্থন করেন এবং আপনি কি চান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রশাসন পরিচালনা করবেন?

এতে ৯৪.৫ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ে এবং মোট ৭২.২ শতাংশ ভোট পড়েছিল বলে দাবি করা হয়

সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সাংবিধানিক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না’ এই বিলে সংসদীয় সরকারের পুনঃপ্রবর্তন, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান হবেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হবেন নির্বাহী প্রধান। এতে উপরাষ্ট্রপতির পদটিও বিলুপ্তির এবং সংসদ কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার বিধান রাখা হয়।

এর ফলাফল ছিল পক্ষে ৮৩.৬ শতাংশ ভোট এবং বিপক্ষে ৩৫.২ শতাংশ ভোট।

বেগম জেসমিন টুলি বলেন, ‘এবারের ভোটের প্রস্তাব বা প্রশ্নগুলো বুঝতে পারবে এমন ভোটার খুবই কম। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে পড়ে দেখে সময় নিয়ে বলতে হবে। আমাদের দেশে ৬০ বছরের ওপরে যাদের বয়স, বিশেষ করে এই বয়সের নারীদের বিশাল একটি অংশ এই চারটি প্রস্তাব বুঝতে পারা তো দূরের কথা, পড়তে কি পারবে? চারটি প্রস্তাবের মধ্যে আরো অনেক বিষয় আছে। এগুলো ভোটারদের জানাতে ব্যাপক প্রচার এবং তার জন্য অনেক সময় দরকার।’

রবিবার বৈঠকে বসবে ইসি

গণভোট নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তুতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ গতকাল বলেন, ‘আগামী রবিবার এ বিষয়ে কমিশনের বৈঠক হতে পারে। সভায় জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে আলোচনা এবং এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ হতে পারে। গণভোটের জন্য কতগুলো ব্যালট বক্স সংগ্রহ করতে হবে, ব্যালট পেপারের জন্য কাগজ সংগ্রহ, আইন প্রণয়নের উদ্যোগ—এসব বিষয়ে কমিশন সভায় আলোচনার পর বলা যাবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া

আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠানের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে রাজনৈতিক দলের মতেরই প্রতিফলন ঘটেছে। তবে এ আদেশকে কেন্দ্র করে নানা সাংবিধানিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির নামে এই ধরনের আদেশ অন্তর্বর্তী সরকারের ম্যান্ডেট ও এখতিয়ারের বাইরে। গণভোটের প্রশ্ন চারটি ভাগে ভাগ করে সরকারের দিক থেকে রাষ্ট্রপতির নামে আদেশ জারি করার বিষয়টি নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব। এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। প্রধান উপদেষ্টা হয়তো বিভিন্ন পক্ষকে খুশি করতে চেয়েছেন। আবার বিশেষ কাউকে বাড়তি সুবিধা দিতে চেয়েছেন। আসলে একটি অনির্বাচিত সরকারের এই ক্ষমতা রয়েছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “এখন গণভোট অপ্রয়োজনীয়। প্রয়োজনে গণভোট হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। এ বিষয়ে আগামী সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে। জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবের পর মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে গণভোট হতে পারে। কিন্তু এখন গণভোটের যেসব বিষয় বলা হয়েছে এবং ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের যে কথা বলা হয়েছে, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপেও এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী দিনে এই গণভোটের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। আইনগত কোনো ভিত্তি থাকবে না। তাই আগে সংসদ নির্বাচন হতে হবে।”

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে মেনে নেওয়ার পক্ষে এবি পার্টি। সরকার বা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে সব দিক বিবেচনা করে একই দিনে গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক ভোটের হিসাবে আসন নির্ধারণ এবং গণভোটে একমত ও ভিন্নমতকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যালট তৈরিসহ চূড়ান্ত নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এটা এখন একটি অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য সমাধান।’

মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘সার্বিক বিচারে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখি। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম, রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু পর্যাপ্ত যুক্তিতর্ক ও আলোচনা এরই মধ্যে শেষ করেছে, তাই এখন সরকারের একটি সমাধানমূলক সিদ্ধান্ত দেওয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। বিএনপি, জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দল বিভক্তি পরিহার করে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও আনন্দমুখর পরিবেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এবং দেশকে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পথে পরিচালনা করবে বলে আশা করছি।’

বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে একই দিনে জাতীয় সংসদ ও গণভোটের কথা বলেছেন। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্য বেড়ে গিয়ে দেশ এক দীর্ঘমেয়াদি সংকটে নিপতিত হতে পারে। বর্তমান সরকার সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ নিয়েছেন। সংবিধান মেনে চলা ও এর রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের সংবিধানে আদেশ জারি বা গণভোটের কোনো বিধান নেই। রাষ্ট্রপতি কেবল অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। এই অবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করিয়ে সরকার সংবিধান পরিপন্থী কাজ করেছে।’

বজলুর রশীদ ফিরোজ আরো বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টের উল্লেখ নেই। অথচ প্রধান উপদেষ্টা ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন তাতে নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ ছিল। সরকার ও ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। কিন্তু এখন যেভাবে গণভোটের কথা বলা হয়েছে, তাতে নোট অব ডিসেন্ট না রাখাটা ড. ইউনূসের নিজের সঙ্গে নিজের এবং রাজনৈতিক দল ও জাতির সঙ্গে প্রতারণার শামিল।’ 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here