‘আইসিসির ওপর ভারতের প্রভাব’ নিয়ে মুখ খুললেন সাবেক ম্যাচ রেফারি

0
‘আইসিসির ওপর ভারতের প্রভাব’ নিয়ে মুখ খুললেন সাবেক ম্যাচ রেফারি

‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ওপর ভারতের প্রভাব’-এই কথাটা হরহামেশাই শোনা যায় কখনো বিশ্লেষকদের মুখে, কখনো দর্শকদের, কখনো বা ক্রিকেটাররা নিজেদের গণ্ডির ভেতরেই বলে থাকেন। এবারে মুখ খুললেন সাবেক ম্যাচ রেফারি, যিনি ক্রিকেটার ও ম্যাচ রেফারি হিসেবে বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ার কাটিয়েছেন।

সাবেক আইসিসি ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড জানিয়েছেন, একসময় তাকে ভারতের দলকে ‘বিশেষ সুবিধা’ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল, এমনকি নিয়ম ভেঙে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়েছিল কেবল ভারতের জন্যই।

দ্য টেলিগ্রাফ-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্রিস ব্রড বলেন, এক ম্যাচে ভারতীয় দল ধীর গতিতে ওভার সম্পন্ন করায় চার ওভার পিছিয়ে পড়ে। নিয়ম অনুযায়ী এতে অধিনায়ক ও দলের ওপর আর্থিক জরিমানা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎই আইসিসি সদর দপ্তর থেকে তার কাছে ফোন আসে।

ফোনে বলা হয়, ‘এটা ভারত, একটু নমনীয় হন, কিছু সময় খুঁজে বের করুন যেন জরিমানার প্রয়োজন না পড়ে।’

ব্রড বলেন, ‘আমাদের তখন বাধ্য হয়ে হিসাব-নিকাশে পরিবর্তন আনতে হয়, সময় বাড়িয়ে দেখাতে হয় যাতে ওভার রেট নিয়মের মধ্যে পড়ে যায়। মূলত আমাকে বলা হয়েছিল, যেভাবেই হোক এটা সামলে নিতে হবে।’

তিনি আরও জানান, পরের ম্যাচেও প্রায় একই পরিস্থিতি তৈরি হয়।

ব্রড বলেন, ‘ভারতের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী তখন কোনো তাড়াহুড়োর নির্দেশ মানেননি। ম্যাচ শেষে আমি আবার ফোন করি আইসিসিতে, জিজ্ঞেস করি এবার কী করব? তখন বলা হয়, ‘এইবার করো জরিমানা।’ অর্থাৎ দেখা গেল, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে নিয়ম নয়, রাজনীতি কাজ করছিল। শুরু থেকেই ক্রিকেটে ক্ষমতার ভারসাম্য একপাক্ষিক হয়ে গেছে।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘এখন অনেকেই এসব বিষয়ে খুব সতর্ক থাকে, কেউ মুখ খোলে না। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিকভাবে অনেক চতুর হয়ে গেছে, তাই এমন বিষয় প্রকাশ্যে আসে না।’

ক্রিস ব্রড জানান, তার সময়কালে আইসিসির প্রশাসন তুলনামূলক স্বাধীনভাবে কাজ করত, কারণ তখন ক্রিকেট বিষয়ক সিদ্ধান্তে অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘ভিন্স ভ্যান ডার বিজল (তৎকালীন আইসিসি আম্পায়ার ম্যানেজার) দায়িত্বে থাকাকালে আমরা সমর্থন পেতাম, কারণ তিনি নিজেও ক্রিকেট থেকে উঠে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন থেকে ভারতীয় প্রভাব ক্রমশ বাড়তে থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের হাতে এখন অর্থ, প্রভাব আর নীতি-সবই। আইসিসির সিদ্ধান্ত এখন অনেকটাই ভারতের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তাই আমি সত্যি বলতে খুশি যে, এখন আর সেই পরিবেশের মধ্যে নেই। কারণ আইসিসিতে এখন যা চলছে, সেটা ক্রিকেট নয়, রাজনীতি।’

ক্রিস ব্রডের এই মন্তব্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং আইসিসির নিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ব্রডের এই বক্তব্য ক্রিকেট প্রশাসনের অন্দরের বাস্তব চিত্রই ফুটিয়ে তুলেছে।

তবে এ বিষয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বা আইসিসির কোনও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এখনও পাওয়া যায়নি।

ক্রিস ব্রড অন্য আম্পায়ারদের মধ্যে ড্যারেল হেয়ারের কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি ছিলেন কড়া মানসিকতার মানুষ, যে কারণে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

ক্রিস ব্রড বলেন, ‘আমি মাঝে মাঝে ভাবি ড্যারেল হেয়ারের কথা, যিনি ছিলেন একদম ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে আপসহীন মানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের বিশ্বাসের কারণেই তাকে আইসিসি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেটাই আমার জন্য ছিল বড় শেখার জায়গা।’

তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটের মাঠে আমরা চেষ্টা করি যতটা সম্ভব সৎ থাকতে, নিজের নীতিতে অবিচল থাকতে। কিন্তু আপনি যখন দেখেন, পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক চাপ ও নানা স্বার্থের খেলা চলছে, তখন বুঝতে পারেন বিষয়টা কতটা জটিল। সেখানে ন্যায়বোধ টিকিয়ে রাখা সহজ নয়।’

ব্রডের মতে, ক্রিকেট প্রশাসনের ভেতরের এই রাজনৈতিক বাস্তবতা অনেক সময় নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তকে বাধাগ্রস্ত করে। তিনি বলেন, ‘আপনি যা ঠিক মনে করেন, সেটাই করতে চান; কিন্তু প্রভাবশালী শক্তি যখন অন্য পথে টান দেয়, তখন সৎ থাকা এক ধরনের সাহসের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।’

কে এই ক্রিস ব্রড

ইংল্যান্ডের হয়ে কিছু দিন আগে অবসর নেয়া তারকা ফাস্ট বোলার স্টুয়ার্ট ব্রডের বাবা ক্রিস ব্রড, তবে তার বড় পরিচয় সাবেক ক্রিকেটার এবং আইসিসির ম্যাচ অফিসিয়াল। ম্যাচ অফিসিয়াল হিসেবে ২০ বছর কাজ করেছেন তিনি।

ক্রিস ব্রড ছিলেন লম্বা গড়নের এক বাঁহাতি ওপেনার, মাঠে তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা এক ভঙ্গিতে খেলতেন, মনের দিক থেকে ছিলেন একগুঁয়ে ও কঠোর ভাবাপন্ন।

১৯৮৩ সালে ব্রড তার নিজ শহরের ক্লাব গ্লুচেস্টারশায়ার ছেড়ে নটিংহ্যামশায়ারে যোগ দেন। কারণ হিসেবে তিনি অভিযোগ করেন, গ্লুচেস্টারশায়ার ‘যথেষ্ট এম্বিশাস’ ছিল না।

তার সিদ্ধান্তকে তখন অনেকেই আত্মকেন্দ্রিক মনে করেছিলেন, কিন্তু ইংল্যান্ড দল উল্টো ঝুঁকি নিয়ে তাকে দ্রুত দলে ডেকে নেয় এবং পরে এটা দারুণ এক সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হয়েছিল।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৮৬-৮৭ সালের অ্যাশেজ সিরিজে ব্রড ইতিহাস গড়েন। সেই অস্ট্রেলীয় দলের বিপক্ষে তিনি পরপর তিনটি টেস্টে সেঞ্চুরি করে কিংবদন্তি জ্যাক হবস ও ওয়ালি হ্যামন্ডের রেকর্ড স্পর্শ করেন।

পরের বছর সিডনিতে আয়োজিত টেস্টেও তিনি ১৩৯ রানের ইনিংস খেলেন, যদিও আউট হওয়ার পর রাগের মাথায় নিজের স্টাম্প ভেঙে দেন, যা তখনকার সময়ে বেশ সমালোচিত ঘটনা ছিল।

এর পর লর্ডসে এক ম্যাচে তাকে এলবিডব্লিউ আউট দেওয়া হলে, ব্রডকে টেলিভিশনে দেখা যায় আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে। এর জেরেই তাকে জাতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হয়।

অফিসিয়ালি বলা হয়, তিনি ফর্ম হারিয়েছেন, কিন্তু আসলে তখন ইংল্যান্ড দল নতুন করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি খানিকটা শান্ত ও পরিণত হন, আবার ফিরে যান গ্লুচেস্টারশায়ারে। 

খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর যোগ দেন বিবিসি টেলিভিশনের ধারাভাষ্যকার হিসেবে। ধারাভাষ্যকার হিসেবে তিনি নির্ভুল, বিশ্লেষণধর্মী ও পরিমিত হিসেবেই পরিচিত ছিলেম। পরে তিনি নতুন ভূমিকায় আবির্ভূত হন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) ম্যাচ রেফারি হিসেবে।

সূত্র : বিবিসি ও দ্য টেলিগ্রাফ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here