খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে লোকসানে খামারিরা, ছেড়ে দিচ্ছেন ব্যবসা

0
খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে লোকসানে খামারিরা, ছেড়ে দিচ্ছেন ব্যবসা

কুমিল্লার লালমাই উপজেলার ছিলোনিয়া গ্রাম একসময় দুধ উৎপাদনের জন্য বেশ পরিচিত ছিল। এই গ্রামসহ পাশের ১২টি গ্রামে এক সময় গরু পালন, দুধ বিক্রি ও খামারির শ্রমিক কাজের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ স্বাবলম্বী ছিলেন। ছিলোনিয়া গ্রামে প্রায় আড়াই শতাধিক পরিবার দুধ উৎপাদন করতো। তাই এটি ‘দুধের গ্রাম’ নামে পরিচিত ছিল।

কিন্তু এখন ছিলোনিয়া এবং পাশের গজারিয়া, হাপানিয়া, উৎসব, পদুয়া, মাতাইনকোট, দোসারি চৌ, জামমুড়া, শাসনমুড়া, আটিটি, বাতোরা গ্রামে দুধ সংগ্রহ ও বিক্রির সেই উৎসব আর নেই। খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে খামারিরা লোকসান ভুগছেন এবং অনেকেই খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু ছিলোনিয়া গ্রামে গত ছয় বছরে আড়াইশ’ খামার থেকে ২০০টি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। খামারিরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গ্রামে এখনো গরুর ডাক শোনা যায়। মাঠে সবুজ ঘাস চাষ করা হয়েছে। কেউ গরুর ঘাস কাটছেন, কেউ গোবর পরিষ্কার করছেন, কেউবা দুধ সংগ্রহ করছেন। হাতে তেল মেখে ওলান থেকে দুধ নেওয়া হচ্ছে। চিরিৎ-চিরিৎ শব্দে দুধ বালতিতে পড়ে, চারদিকে মিষ্টি দুধের ঘ্রাণ ছড়িয়ে যায়। ভোরের সোনালি আলো বালতিতে পড়া সাদা দুধকে চকচকে দেখায়। তবে দুধের মূল্য কমে যাওয়ায় এই দৃশ্য খামারিদের কাছে এখন বিবর্ণ মনে হচ্ছে। আগের মতো উৎসবের আমেজ আর নেই; অনেক খামার খালি পড়ে আছে। কোথাও আগে ২০টি গরু থাকত, এখন সেখানে দুটি গরু আছে। খামার যেন মেলার শেষের ভাঙা হাটের মতো। খাবার দেওয়ার পাত্র খালি, কোথাও বাড়ির ব্যবহার্য জিনিস রাখা আছে, আবার কোথাও মাছ ধরার ছাই বা কনুই জাল দেখা যায়।

খামারি নাইমুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে আমার ১৮টি গাভী আছে। দুধের দাম কম এবং খাদ্যের দাম বেশি। তাই অনেক খামারি ব্যবসা থেকে সরে যাচ্ছেন। খাদ্যের মূল্য ও দুধের বাজার মনিটরিং হলে খামার বাঁচবে।

খামারি জয়নাল আবেদীন বলেন, ২০০৮ সালে তিনটি গাভী দিয়ে ব্যবসা শুরু করি। বর্তমানে আছে ২৩টি। করোনার সময়ে দুধ বিক্রির ঝামেলায় লোকসান হয়েছে। গরু ও বাচুর বিক্রি করে খামার চালিয়েছি। এখন এক কেজি খাদ্যের দাম ৫৫ টাকা, পাইকারি এক কেজি দুধের দাম ৪০ টাকা। শ্রমিকের আগের দাম ছিল ৩০০ টাকা, এখন ৭০০ টাকা। আয় যদি ৩ হাজার হয়, খরচ ৫ হাজার। এখন খামারে কমতে কমতে ১৩টি গাভী আছে।

খামারি সেলিম মিয়া বলেন, আমার আটটি দুধের গাভী ছিল। খাদ্যের দাম বাড়ায় বিক্রি করে দিতে হয়েছে। পানি এক কেজির দাম ৩০ টাকা, দুধ এক কেজির দাম ৪০ টাকা! কিভাবে খামার টিকবে?

সফিকুর রহমান বলেন, লোকসান দিতে দিতে খামারিরা অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। আগে আমার ১৮টি গরু ছিল, এখন শুধু আছে একটি।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন কুমিল্লা জেলার সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল আজিজ বলেন, ২০০৬ সালে ডেইরি ফার্ম শুরু করি। ২০১৯ পর্যন্ত ভালো ব্যবসা চলছিল। ২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় পিছিয়ে যেতে শুরু করি। ২০২০-২২ সালের মধ্যে ব্যবসা মোটামুটি ভালো ছিল। এরপর থেকে লস দিতে দিতে অনেকে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। আগে এই এলাকায় ২৫০টি খামার ছিল, এখন তা মাত্র ৬০টিতে নেমেছে। সরকার দৃষ্টি না দিলে বাকি খামারিরাও হারিয়ে যাবেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ দফতরের জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার ডা. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বলেন, কুমিল্লা জেলায় দুধের বাৎসরিক চাহিদা ৫.৩৪ লাখ মেট্রিক টন, বিপরীতে উৎপাদন ৫.০৩ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন বাড়াতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। দানদার খাদ্যের দাম বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। খামারিরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। আমরা খামারের বিদ্যুৎ বিল কৃষির আওতায় আনার এবং খাদ্যে ভর্তুকি প্রদানের বিষয়েও কাজ করছি। এছাড়া ঘাস জাতীয় খাদ্যে নজর দিতে বলেছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here