গাজায় এখন একটাই প্রশ্ন, ‘তুমি কি আজকে কিছু খেয়েছো?

0
গাজায় এখন একটাই প্রশ্ন, ‘তুমি কি আজকে কিছু খেয়েছো?

‘মা, পনেরোটা চকলেট আর বিস্কুট কিনে দাও’– এই কথা বলে প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে তিন বছর বয়সী নূর। পনেরো! কারণ সেটাই তার জানা সবচেয়ে বড় সংখ্যা। মনে হয় এতো চকলেট-বিস্কুটেই হয়তো আগের পৃথিবীটা আবার ফিরে আসবে। কিন্তু তার মায়ের জন্য এটা এক অসম্ভব আবদার। গাজার ধ্বংসস্তূপে আজ কোনো দোকান নেই, বাজার নেই, চকলেট নেই, বিস্কুট তো বহু দূরের কথা।

নূর গাজার দারাজ এলাকায় তার মা তাসনিমের কোলে বেড়ে উঠছে। তার ভাই ঈয আল-দীন, মাত্র ছয় মাসের শিশু; জন্ম নিয়েছে যুদ্ধের মধ্যেই।  ঈয কখনো আসল খাবার দেখেনি, কখনো জানতে পারেনি বিকল্প কী জিনিস। সে শুধু একটি শব্দ জানে – ওব্জ! ওব্জা!, মানে খোবজা– এক টুকরো রুটি। তার একমাত্র চাওয়া।

তাসনিম তাকে বোঝাতে বাধ্য হন, আটা নেই, বাবু। তোমার বাবা খুঁজতে গেছে।

কিন্তু এই বোঝানো কি সম্ভব? শিশুদের কাছে অনাহার, অবরোধ বা রাজনীতি– এসবের আলাদা কোনো মানেই নেই। তারা শুধু জানে, তাদের পেট খালি।

সম্প্রতি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে এক ব্যক্তি কাঁদছেন সাতটি মৃতদেহের পাশে। তার পরিবারের সবাই অনাহারে ভুগে পাঁচ দিনের মাথায় নিহত হয় এক ড্রোন হামলায়। তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। ভাতার অভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন সবাই।

তিনি কাঁদছেন, বলছেন, আমি এই ছেলেটিকে লালন-পালন করেছি। এখন দেখো, কী অবস্থায় আছে। এটি একটি মুহূর্ত নয়, এটি পুরো একটি বাস্তবতা।

গাজায় আজ কোটি টাকা থাকলেও আপনি এক মুঠো চাল, এক ফোঁটা দুধ, এমনকি একটা ডিমও কিনতে পারবেন না। বাজারের তাকগুলো কেবল খালি নয়, বাজার বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই নাই আর।

এক সময় গাজা নিজস্ব উৎপাদনে স্বনির্ভর ছিল। স্থানীয়ভাবে তৈরি দই, পনির, শাকসবজি, ফলমূল সবকিছুই উৎপাদিত হতো এখানে। খান ইউনিসের তরমুজ ২১ কেজি পর্যন্ত হতো। দাম ছিল মাত্র ১৮ শেকেল (৫ ডলার)। আজ যদি কোথাও পাওয়া যায় দাম ২৫০ ডলার!

যেসব জিনিস পশ্চিমারা লাক্সারি বলে জানে– অ্যাভোকাডো, স্ট্রবেরি সেগুলো একসময় এখানে টনকে টন উৎপাদিত হতো। আজ গাজার সমুদ্রও স্তব্ধ। মাছ নেই, দুধ নেই, জীবন নেই।

এক ছাত্রী বলেন, আমরা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রী। পরীক্ষা দিচ্ছি অনলাইনে– কারণ ক্যাম্পাস ধ্বংসস্তূপে পরিণত। তিনি বলেন, “এক হাত ড্রোনের শব্দে, আরেক হাতে ক্ষুধার জ্বালায় মাথা ধরে রয়েছে, এর মাঝেই পরীক্ষা দিচ্ছি। এটা কোনো সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়জীবন নয়।

হোয়াটসঅ্যাপে তার সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিদিনের আলোচনায় ক্লাসের কোনো বিষয় নেই। তাদের কথোপকথন এখন অনেকটা এরকম, ‌‘আজ কী খেয়েছো? মাথা ঘুরছে? দাঁড়িয়ে থাকতে পারছো?’

এইভাবেই চলছে তাদের একেকটি দিন। শেষ সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষা ১৫ জুলাই। তারিখটি মনে রাখার কারণ ক্ষুধা ও বোমার ভেতরেও তারা ছাড় দেয়নি। কারণ, তারা জানে– পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াই একমাত্র প্রতিরোধ।

একদিন পরীক্ষা চলাকালে পাশের বাড়িতে বোমা পড়ে। বিস্ফোরণের শব্দে দেয়াল কেঁপে উঠে। তবু সে ছাত্রী পালায়নি। সে পড়ে চলেছে। চোখে অশ্রু, মনে শুধুই একটিই কথা, পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই।

এই দুর্ভিক্ষ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটি একটি ইচ্ছাকৃতভাবে চাপানো মানবিক বিপর্যয়। গাজাবাসীরা অনাহারের শিকার, কারণ তাদের খাদ্য ও ওষুধ ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। সীমান্ত বন্ধ, সাহায্য আটকানো।

এই দুঃসময় শুধুই সহানুভূতির সময় নয় এটি ন্যায়বিচার দাবি করার সময়। যারা শব্দচয়ন নিয়ে খেলছে, সংকট, দুর্দশা, অভাব তারা দায় এড়িয়ে যেতে চায়।
কিন্তু গাজার মানুষ চুপ থাকবে না।

নূর চকলেট চায়, ঈয এক টুকরো রুটি। একদিন তারা হয়তো আর কিছু চাইবে না; কারণ তারা বুঝে যাবে, এই পৃথিবী কিছুই দেয় না। কিন্তু সেই দিন যেন না আসে। এই অনাহারের গল্প থামাতে হবে এখনই।

সূত্র: আল জাজিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here