প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ১৭৩টি দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নাজমুন নাহার। ১৭৩তম দেশ হিসেবে ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়েন আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কার ভ্রমণের মাধ্যমে। গৌরবময় এই নারী নাজমুন নাহার বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে এভাবেই দুর্বার গতিতে লাল সবুজের পতাকা ও বিশ্ব শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন মানুষের মাঝে।
নাজমুন এ বছরের শুরুতেই এবারের অভিযাত্রা শুরু করেন মঙ্গোলিয়া থেকে। ১৬৮তম দেশ হিসাবে মঙ্গোলিয়া ও দুর্গম সাইবেরিয়া অঞ্চল অভিযাত্রা করেন ডব্লিউপিসি- ওয়ার্ক পারমিট ক্লাউডের পৃষ্ঠপোষকতায়। মঙ্গোলিয়ার জনপ্রিয় পত্রিকা ‘জুনিমেডে (সেঞ্চুরী)’ এবং গো পো গণমাধ্যম নাজমুনকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্ব ভ্রমণের সংগ্রাম ও সফলতা নিয়ে।
এই পাঁচটি দেশে নাজমুন ভ্রমণ করেন ৫৬ হাজার ৭৭ কিলোমিটার পথ। যা ছিল অত্যন্ত দুর্গম এবং কঠিনতম দেশ ভ্রমণের অংশ। এই সফরে বাংলাদেশের পতাকা বাহনের পাশাপাশি ইউকে বেসড টিভি চ্যানেল, চ্যানেলে এস এর উদ্যোগে ২৬টি চ্যারিটিকে সহযোগিতার জন্য মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন নাজমুন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ, দুর্যোগ, বন্যা, খরা, ক্ষুধার্ত মানুষকে সহযোগিতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কাজসহ মানবিকতার কল্যাণে বিশ্ব ভ্রমণের মাঝে আর্ত মানবতার সেবায় নাজমুন নাহার এই রমজানে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে RFC- ‘রামাদান ফ্যামিলি কমিটমেন্ট’ এর ব্রিটেনের ২৬ টি চ্যারিটিকে সহযোগিতার জন্য ফান্ড রেইজে সাপোর্ট করেন, তাই ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকেই যুক্ত হয়েছেন এই ক্যাম্পেইনের একজন ভলেন্টিয়ার হিসেবে।
নাজমুন বলেন, আমার বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে নানাভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। এই সফরে আমি মঙ্গোলিয়া, সিরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সী শেল ও মাদাগাস্কারে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মাঝে খাবার ও কিছু সহযোগিতা বিতরণ করেছি।
মানবতার কল্যাণে ফিলিস্তিনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের কল্যাণে যদি আমরা সবাই একসাথে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি তাহলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে, এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে আমরা যদি সোচ্চার হই তবেই পৃথিবীতে নেমে আসবে শান্তি। তাই নাজমুন এই রমজানে ভলেন্টিয়ার হিসেবে RFC’র ২৬ টি চারিটিকে সহযোগিতার জন্য ক্যাম্পেইন করেন এই ৫টি দেশে।
নাজমুন নাহার একজন হার না মানা দুর্বার নারী, ইতিপূর্বে তার বিশ্ব ভ্রমণের কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো সেটাই প্রমাণ করেছে। নাজমুন বহু প্রতিকূলতার মাঝে পৃথিবীর ভ্রমণ করছেন। যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে- সকল শঙ্কা, ভয়কে উপেক্ষা করে মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নাজমুন এগিয়ে চলছেন পৃথিবীর পথে পথে।
এই রমজানে ব্রিটেন থেকেই শুরু হয়েছিল নাজমুন নাহারের এই সফর। বিশ্ব ভ্রমণের এই ৫টি দেশ সফর ছিল জীবনের আরেকটি বড় কঠিনতম চ্যালেঞ্জ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ভ্রমণ ছিল তার জন্য অনেক কঠিন পদক্ষেপ। তারপরও লেবানন থেকে সিরিয়ার দামাস্কস ও অন্যান্য শহরগুলো ভ্রমণ করেন। RFC’র শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে সিরিয়ার বেশ কিছু দরিদ্র শিশুদেরকে সহযোগিতা করেন।
তারপর তিনি পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর ভ্রমণ করে পেশওয়ারে পৌঁছান। সেখানে আফগানিস্তানের অ্যাম্বাসি থেকে তালেবান অফিসারের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আফগানিস্তানের ভিসা সংগ্রহ করেন। তারপর, ইতিপূর্বে বোমা হামলা সংঘটিত পাকিস্তানের খাইবার পাসের দুর্গম উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলের লোন্ডিকোতল গ্রামসহ অসংখ্য গ্রামে মানুষেকে ভিজিট করেন নাজমুন এবং সেখানে মানুষকে সহযোগিতা করেন ও তাদের দুঃখ দুর্দশাকে অবলোকন করেন।
পরবর্তী অভিযাত্রায় নাজমুন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের তুরখাম বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছান। পাকিস্তানের দুর্গম সেই বর্ডারে ইন্টেলিজেন্স সিকিউরিটি ফোর্স, বর্ডারের অফিসার, পুলিশ চেকপোস্টে সবার কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে তিনি বর্ডার অতিক্রম করে আফগানিস্তানের বর্ডারে পৌঁছান। সেখানে তালেবান অফিসারদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বর্ডার ক্রস করেন।
তারপর শুরু হয় আফগানিস্তানে আরও কঠিন পথ ভ্রমণ। নাজমুন বলেন, আফগানিস্তানে পা দেওয়ার সাথে সাথে মানুষ আমাকে সাবধান করে দিয়েছেন একজন নারী হিসেবে আমার যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তালেবান এর নিয়ম অনুযায়ী পরিপূর্ণ হিজাব পরে যদিও আমি আফগানিস্তান ভ্রমণে এসেছি তবু সবাই বলেছেন এই দেশে কাউকেই বিশ্বাস করা যাবে না। আমার বুকের ভিতর তখন নানা ধরনের আতঙ্ক, পথে বোমা হামলার ভয়, দুর্গম পাহাড়ি পথে অ্যাক্সিডেন্টের শঙ্কা থাকলেও আমার বিশ্বাস ছিল বিধাতা আমাকে কোনভাবে ছায়া দিয়ে রাখবে। তারপর সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে আমি আফগানিস্তানের জালালাবাদ শহরে অবস্থান করি। সেখান থেকে পরের দিন পার্শ্ববর্তী বেহুঁশুত ও বিভিন্ন গ্রামের দরিদ্র মানুষকে পরিদর্শন করিও তাদের কিছু ব্যক্তিগত সহযোগিতা করি। তারপর কাবুলের আরও কঠিন পাহাড়ি দুর্গম পথ অতিক্রম করে কাবুল রওনা হই।
নাজমুন আরও বলেন, যেখানে নারীদের জন্য বন্ধ রয়েছে জানালা, কঠিন থেকে কঠিনতম আফগানিস্তানের খাইবার পাসের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল অতিক্রম করে জালালাবাদ থেকে কাবুল রওনা হই। অস্ত্র জড়ানো অগণিত তালেবান সিকিউরিটি চেকপোস্টের মুখোমুখি হয়ে নানান প্রশ্নের জবাব দিয়ে পার হতে হয়েছে আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি পথ।
অচেনা সেই দুর্গম পথে বোমা হামলার আতঙ্ক, শঙ্কা প্রতি মুহূর্তেই ছিল সঙ্গী। কাবুল পৌঁছানোর পর সাথে ছিল তার দুইজন গাইড। কাবুলের বিভিন্ন এতিমখানা ও স্কুল সফর করি তালেবানের অনুমতিপত্র নিয়ে, সেখানে ছবি তোলা ছিল সম্পূর্ণ নিষেধ।
এছাড়া কাবুলের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করার জন্য যেখানেই আমি গিয়েছি সেখানেই যেন অদৃশ্যভাবে পৌঁছে গেছে তালেবানের সিকিউরিটির গাড়ি, আমাদের পিছনে পিছনে তালেবান পাহারত, তা আমি জানতাম না। আমার দুই গাইডের কঠিন প্রহরী ও বুদ্ধিতে খুব সাবধানে কয়েকদিনে কাবুল সফর শেষ করে আমি আফ্রিকাতে রওনা হয়েছিলাম। আফ্রিকার সামুদ্রিক দেশ সী শেল এর প্রাকৃতিক লীলাভূমিতে আমি যখন পৌঁছেছি তখন পেছনের কঠিন পথের স্মৃতিগুলো আমাকে বারবার তাড়িত করেছে। সী শেল এ নাজমুন দুটো স্কুল সফর করেন এবং শান্তির বার্তা ও পরিবেশ রক্ষার ক্যাম্পেইন করেন। সী শেল সফর শেষে নাজমুন কেনিয়া হয়ে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ মাদাগাস্কারে পা রাখেন।
নাজমুল মাদাগাস্কারে বিভিন্ন বস্তিতে অসহায় মানুষকে ভিজিট করেন। নাজমুন বলেন, মাদাগাস্কারের মানুষের দারিদ্রতা দেখে আমার চোখে পানি এসেছে। মাদাগাস্কারে কিছু অসহায় মানুষকে আমি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছি এবং তাদের মাঝে খাবার বিতরণ করেছি।
মাদাগাস্কারে ক্ষুধার জ্বালায় অনেক অসহায় বাচ্চাকে কাঁদতে দেখেছি। আনতানানারিভো শহরের কোনায় কোনায় মানুষকে ময়লার ড্রাম থেকে খাবার কুড়িয়ে খেতে দেখেছি। আমার মাদাগাস্কার ভ্রমণের মাঝেই বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছিল সাইক্লোন।
দেশটি প্রাকৃতিকভাবে অপূর্ব সুন্দর, বিভিন্ন অর্গানিক ফলের জন্য বিখ্যাত হলেও এখনো এখানকার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে।
মাদাগাস্কারের বিভিন্ন শহরে লাল সবুজের পতাকা উড়ান নাজমুন এবং তাদের ঐতিহাসিক জীবন ও সংস্কৃতিকর স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করেন। এভাবেই ১৭৩তম শেষ পর্যন্ত ভ্রমণ করেন নাজমুন নাহার।
নাজমুন বলেন, ফিলিস্তিনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অসহায় দরিদ্র মানুষকে সহযোগিতার জন্য চ্যানেলের এস এর উদ্যোগে RFC রামাদান ফ্যামিলি কমিটমেন্ট এর ক্যাম্পেইনে তিনি মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন এই সফরের মাধ্যমে।
নাজমুন ভ্রমণ করবেন বিশ্বের প্রতিটি দেশ। ২০০০ সলে ভারতের ভূপালের পাঁচমারিতে ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল এডভেঞ্চার’ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে তার প্রথম বিশ্ব ভ্রমণের সূচনা হয়। ১ জুন ২০১৮ সালে ১০০তম দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ের সীমান্তের ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের উপর। ১৫০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন আফ্রিকা মহাদেশের দেশ সাওতমে অ্যান্ড প্রিন্সিপ। ২৪ বছর ধরে নাজমুন পৃথিবীর এক দেশ থেকে আরেক দেশে বিভিন্ন জনপদের মাঝে বাংলাদশের পতাকাকে তুলে ধরার মাধ্যমে শান্তির বার্তা ছড়িয়েছেন এবং উৎসাহিত করেছেন লাখ লাখ তরুণকে।
এরমধ্যে নাজমুন ব্রিটেন থেকে পেয়েছেন ইনস্পিরেশনাল উইমেন্স আওয়ার্ড। দেশ-বিদেশে তার ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৫৫টির মতো অ্যাওয়ার্ড। তিনি পড়াশোনা করেছেন সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে।
নাজমুন নাহারের ২৪ বছরের এই বিশ্ব ভ্রমণ প্রতিটি দেওয়াল ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। আলোকিত এই নারীর পৃথিবী ভ্রমণ এবং তার মহৎ কাজের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্ব মানবতার জয়গান।