স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ আর রাজনৈতিক মদদে ব্যাংক পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে টাকা লোপাটের কারণে গভীর সংকটে দেশের ১০টি ব্যাংক। এই ১০টি ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংক খাতের ৭৬০ জন পরিচালকই দুই লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এসব ঋণ ফেরত না আসায় এখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি গিয়ে ঠেকেছে দুই লাখ ৮৫ হাজার কোটিতে। এখন সংকটে থাকা ১০ ব্যাংককে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে খেলাপি ঋণ ও পাচারের টাকা উদ্ধারে টার্গেট করা হয়েছে দেশের শীর্ষ ১০টি গ্রুপকে। শিল্প বাঁচিয়ে টাকা আদায়ের কৌশল না নিয়ে বরং ত্বরিতগতিতে প্রবল চাপ দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০টি ব্যাংককে টেনে তোলার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে অন্য সবল ব্যাংক থেকে সাময়িক ধারে অর্থ সহায়তা দেওয়া হলেও উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নিয়োজিত ১০টি গ্রুপকে টিকিয়ে রাখার বদলে বরং বন্ধের আয়োজন করা হচ্ছে। এর সঙ্গে অব্যাহতভাবে সংকটে থাকা ব্যাংক ও শীর্ষ গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার বা ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ এসব ব্যাংক ও গ্রুপগুলোকে আরো নাজুক করে তুলছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পুরো অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী সরকারের সময় থেকে ব্যাংকিং খাত রীতিমতো সংকটে। এর মধ্যে ১০টি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর নেপথ্যে মূল কারণ হলো অনিয়মের মাধ্যমে বেনামি ঋণ, ঋণ ছাড়ে ‘পরিবারতন্ত্রের’ ব্যবহার, সংঘবদ্ধভাবে কয়েকটি গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যমূলক ‘মিডিয়া ট্রায়াল’, ঋণের টাকা বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করা, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণ অনুমোদন, ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ও দুর্নীতি, ব্যাংক আইনের অপব্যবহার করে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ২৯ বছর পর্যন্ত ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগ, আগের ঋণ শোধ করতে নতুন ঋণ অনুমোদন, নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে ‘দেউলিয়া’ বলে প্রচার এবং আস্থা ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া।
এত সব কারণে ব্যাংকগুলোর এখন টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে পদক্ষেপ নিলেও এখনো এর সুফল দৃশ্যমান নয়। এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া সাত হাজার ৩৫০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এসব সহায়তায় ভর করে হয়তো আগামী ছয় মাস টিকে থাকতে পারবে ব্যাংকগুলো।
কিন্তু ঋণের টাকা আদায় করতে না পারলে সামনে সংকট আরো গভীর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। টাকা আদায়ে ব্যাংকগুলো দেশের শীর্ষ ১০টি গ্রুপকে টার্গেট করেছে। এসব গ্রুপে ‘রিসিভার’ বসানোর উদ্যোগের কথাও শোনা যায়। যদিও আদালতের নির্দেশ ছাড়া ‘রিসিভার’ নিয়োগের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশে বেক্সিমকো গ্রুপে ‘রিসিভার’ দেওয়া হয়েছে। এর ফল হয়েছে আরো নেতিবাচক। এরই মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ১৮টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার কর্মী। আর বাকিগুলোতে ‘রিসিভার’ দেওয়াসহ অন্য নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দসহ বিভিন্ন পদপেক্ষ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ত্বরিত পদক্ষেপে গ্রুপগুলোকে জিম্মি করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করা হলে টাকা আদায় তো হবেই না বরং প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরো নাজুক হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ব্যাংকাররা।
এসব বিষয়ে তারল্য সহায়তা পাওয়া ন্যাশনাল ব্যাংকের পুনর্গঠিত পর্ষদের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও সীমান্ত ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুখলেসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত পরিবারতন্ত্র, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পরিচালক ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই ব্যাংকগুলো সংকটে পড়েছে। সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় ধার করে তারল্য সহায়তা দেওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। তবে এটা সাময়িক পদেক্ষপ। এখন খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারলে ব্যাংকগুলো আগামী ছয় মাস পর আরো সংকটে পড়বে। কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে কৌশলে। যে ১০টি গ্রুপের কথা বলা হচ্ছে, এসব গ্রুপে লাখ লাখ মানুষ কাজ করছে। এসব গ্রুপের শিল্প-কারখানায় পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদন কর্মকাণ্ড জারি রেখেই টাকা আদায় করতে হবে। বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল। এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না, যার ফলে শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ কাজ হারায়। তখন ব্যাংকও টাকা ফেরত পাবে না। আবার অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে বিপুল অঙ্কের টাকা ধার দেওয়া হয়েছে মূলত সবল ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে। শর্ত ছিল তারা ধীরে ধীরে ধারের টাকা শোধ করবে। কিন্তু তথ্য বলছে, সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো ধারের টাকা শোধ করতে পারছে না। এখন বাধ্য হয়ে তাদের ধার ফেরত দিতে সময় বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর আন্ত ব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে দুর্বল পাঁচটি ব্যাংককে সবল ব্যাংক থেকে ধার নিতে গ্যারান্টি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলো প্রথম ধাপে সবল ব্যাংক থেকে ৯০০ কোটি টাকার গ্যারান্টি পায়। শর্ত ছিল তিন মাসে এই ধার শোধ করতে হবে। তবে তিন মাস সময় পার হয়ে গেলেও ব্যাংকগুলো অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি।
তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত সাতটি ব্যাংক সাত হাজার ৩৫০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা পেয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। ব্যাংকটি দুই হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার তহবিল পায়। এ ছাড়া সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এক হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এক হাজার কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক ৪০০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২৯৫ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক ৯২০ কোটি টাকা এবং এক্সিম ব্যাংক ৭০০ কোটি টাকা তারল্য পায়। যদিও গ্যারান্টির আওতায় পাওয়া টাকা দিয়ে ব্যাংকগুলোর সংকট কাটেনি।
যেসব শিল্পগ্রুপ ঋণের টাকা নিয়ে শোধ না করে খেলাপি হয়েছে, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা জরুরি। কিন্তু একদিকে তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন, অন্যদিকে তারা পণ্য উৎপানেও নিয়োজিত। আবার তাদের নামে ব্যাংকে লাখ লাখ কোটি টাকার ঋণ। এখন তাদের কাছ থেকে ত্বরিতগতিতে টাকা আদায় করতে গিয়ে একেবারে শিল্প বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এরই মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মীরা এখন শিল্প খুলে দেওয়া এবং বকেয়া পেতে সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে রয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্য গ্রুপের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি নেওয়া হলে ভালোর চেয়ে বরং ক্ষতিই বেশি হবে।
জানা যায়, ব্যাংকগুলো এত বিপুল অঙ্কের ঋণখেলাপি হওয়ার পেছনে শুধু যে পর্ষদ পরিচালকরাই দায়ী তা-ই নয়, বরং এই কাজে সহায়তা করেছেন ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহী থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারাও। তাঁরা যোগসাজশ করে এসব অনিয়মের ঋণ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা এখন অন্তরালে, আলোচনার বাইরে। তাঁদেরও এখন শাস্তির আওতায় আনার কথা উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংক খাতে পরিচালকদের ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এই ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আট বছরে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৬০ শতাংশ। দেশে বর্তমানে নতুন ও পুরনো মিলিয়ে সরকারি ও বেসরকারি ৫২টি এবং ৯টি বিদেশি ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকের মোট পরিচালকের সংখ্যা ৭৬০ হলেও এ ধরনের সমঝোতাভিত্তিক বড় অঙ্কের ঋণ বিনিময় করেন শতাধিক পরিচালক, যাঁদের মধ্যে ডজনখানেক সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত। মূলত তাঁদের কাছেই পুরো ব্যাংকিং সেক্টর জিম্মি।
এদিকে খেলাপি ঋণ আদায়ে কার্যকর কৌশল না নিয়ে বিভিন্নভাবে শীর্ষ গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপপ্রচার বা ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করার অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি মিডিয়ার বিরুদ্ধে। তারা ১০টি ব্যাংককে টিকে থাকার নীতি-কৌশল নিয়ে যতটা না সোচ্চার ছিল, তার চেয়ে বেশি করেছে অপপ্রচার। এর ফলে গ্রাহকের আস্থা কমেছে ব্যাংকগুলোর প্রতি। এতে গ্রাহকরা একসঙ্গে ব্যাংকমুখী হয়ে আমানতের টাকা তুলে নিতে ব্যাংকগুলোতে ভিড় করেছে। এতে তারল্যে টান পড়েছে। কিন্তু এখন গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে ব্যাংকগুলো কিভাবে টিকে থাকবে, কিভাবে খেলাপি ঋণের বিপুল অঙ্কের টাকা ফেরত আসবে, কোন পদক্ষেপ নিলে শিল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে মানুষের কাজের সুযোগ সংকুচিত না করে খেলাপি ঋণ আদায় করা যায়—এসব বিষয়ে ওই সব গণমাধ্যমকে কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে না। এতে ব্যাংকের পাশাপাশি বড় গ্রুপগুলোর অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরও বলেছেন, ব্যাংকের নাজুক অবস্থার জন্য এককভাবে কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপ দায়ী নয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ১০ ব্যাংক ধ্বংস করার পর একই চক্রান্তে ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপকে ধ্বংস করার নীলনকশা চলছে। এরই মধ্যে দেশের রপ্তানিবাজার হুমকির মুখে পড়েছে। বিদেশি অর্ডার চলে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশে। চক্রটি এমন সুকৌশলে ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে যে এতে দেশের বেসরকারি খাত ও শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। ক্রমেই ব্যবসা-বিনিয়োগ চলে যাবে ভিন্ন দেশে। আর মানুষ হারাবে কাজের সুযোগ। অর্থনীতি হবে নড়বড়ে। এ লক্ষ্যে কয়েকটি স্বার্থান্বেষী মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাঁদের।
সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ