ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলেও ঝিমিয়ে পড়া দেশের অর্থনীতিতে গতি ফেরেনি। এখনো স্থবিরতা বিরাজ করছে ব্যবসা-বিনিয়োগে। ফুটপাত থেকে নামিদামি শপিংমল কোথাও নেই জমজমাট বেচাকেনা। হোটেল, রেস্তোরাঁতেও নেই কাঙ্ক্ষিত ভিড়। শীত মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও পর্যটন এলাকাগুলোতেও পর্যটকদের ভিড় কম। শিল্পোউদ্যোক্তা, কলকারখানার মালিক ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাই রয়েছেন পর্যবেক্ষকের ভূমিকায়।
শেয়ারবাজারে সূচক কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পথে পথে ঘুরছেন। গত এক বছরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জেরে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক শিল্পকারখানা পুনরায় চালু করা যায়নি। গতি নেই ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়াতেও। হু হু করে রেমিট্যান্স বাড়লেও ডলারের দাম কমেনি। মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো ৮ শতাংশের ওপরে। অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহকে সহায়তা দিতে ব্যাংকগুলো থেকে অতিরিক্ত ডলার
কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) ১৩টি ব্যাংক থেকে মোট ২০ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার (২০২ মিলিয়ন ডলার) কেনা হয়েছে। এ সময় প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ১২২ টাকা ২৭ পয়সা থেকে ১২২ টাকা ২৯ পয়সা পর্যন্ত। কাট-অফ রেট ১২২ টাকা ২৯ পয়সা, যা মাল্টিপল প্রাইস নিলাম পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। বাজেট বাস্তবায়নেও নেই কাঙ্ক্ষিত গতি। রাজস্ব আদায়ে কিছুটা প্রবৃদ্ধি হলেও গত বছরের তুলনায় কমেছে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ।
টানা চতুর্থ মাসের মতো পতনের ধারায় রয়েছে দেশের রপ্তানি খাত। নভেম্বরে রপ্তানি আয় ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ অর্থনীতি কিছুটা চাঙা হতে পারে। কেননা নির্বাচনি প্রচারণা, প্রার্থীদের যাওয়া-আসাসহ বিভিন্ন কারণে গ্রামীণ এলাকায় অর্থের সরবরাহ বাড়বে। এতে করে গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতি কিছুটা গতি পেতে পারে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
কিন্তু সামনে নির্বাচন রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৎপরতা বাড়লেও দেশের অর্থনীতিতে তার কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। সাধারণত নির্বাচন ঘিরে যে বাড়তি ভোগব্যয়, বিনিয়োগ ও বাজারে চাঙাভাব তৈরি হয়, এবারে তা অনেকটাই অনুপস্থিত। মূল্যস্ফীতির চাপ, ডলারের বাজারে ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা ও বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব ও দারিদ্রতা বেড়ে যাওয়াসহ সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। ফলে নির্বাচনের মাত্র দুই মাস বাকি থাকলেও অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার হচ্ছে না।
এদিকে রাজধানীর নিউ মার্কেট, গুলিস্তান, চকবাজারসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নির্বাচনি মৌসুম এলেও ক্রেতার উপস্থিতি আশানুরূপ নয়। প্রচারসামগ্রী, পোশাক, সাউন্ড সিস্টেম ও পরিবহন খাতে যে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হওয়ার কথা, এবার তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী মোখলেসুর রহমান বলেন, আগে নির্বাচন এলেই বিক্রি বেড়ে যেত। এবার দোকান খোলা থাকলেও ক্রেতা নেই। শীত ও নির্বাচন দুটোই থাকলেও ক্রেতা একেবারেই কম। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের চাপ ও তারল্যসংকট এখনো বড় উদ্বেগের কারণ।
কেননা, গত ২৫ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে খেলাপি ঋণ। এরই মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকে ঋণের সুদের হার বেড়েছে। ফলে শিল্প ও বাণিজ্য খাতে ঋণপ্রবাহ কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। শিল্পে নতুন বিনিয়োগ তো নেই দীর্ঘদিন ধরেই। তবে কমেছে পাচারের পরিমাণ। বন্ধ হয়েছে রেমিট্যান্সের অবৈধ পথ। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। রিটেইল চেইন ব্র্যান্ড শপের মালিক জাহিদ আহমেদ টিটু বলেন, মানুষের হাতে টাকা নেই। কাজের পরিধি কমেছে।
ফলে নির্বাচন সামনে থাকলেও স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই প্রতিষ্ঠান কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছেন। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার দায়িত্বে এলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। আমরা ব্যবসায়ীরা সে অপেক্ষাতেই আছি।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো চাপের মুখে রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এ চাপ আরও বাড়তে পারে। অবশ্য এ চাপ সামাল দিতে কৃচ্ছ্রসাধনের পথেই হাঁটছে সরকার। জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত বিদেশ ভ্রমণ ও গাড়ি কেনা বন্ধ রাখা হয়েছে অর্থবছরের বাকি সময়েও। একই সঙ্গে ফেব্রুয়ারির আগেই বাজেট সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সে কাজ শুরুও করেছে অর্থবিভাগ। অবশ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন যে পে-কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেই কমিশন খুব দ্রুত গতিতে কাজ করছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারে নামতে পারে, যা বর্তমানে প্রতি ব্যারেল বিক্রি হচ্ছে ৬৮ ডলারে। এতে কৃষি ও খাদ্য খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ভরা মৌসুমে শাকসবজি, মাছ-মাংসের দাম চড়া। বেড়েছে জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের দাম। এর ফলে বাড়ছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। অথচ বাড়ছে না মানুষের আয়। তৈরি হচ্ছে না নতুন কোনো কর্মসংস্থান।

