নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে তিন দিনব্যাপী বউমেলা শুরু হয়েছে। পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে প্রতিবছর ঐতিহাসিক বউ মেলা বসে। গতকাল শনিবার ভট্টপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে পহেলা বৈশাখের পরদিন এ মেলা বসে। প্রায় দুইশ বছরের আদি বটবৃক্ষের নিচে এ মেলাকে সনাতন ধর্মালম্বীর অনেকে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মেলা ও বটবৃক্ষকে সিদ্ধেশরী দেবী বলে আখ্যায়িত করেন। পুরানো এ বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে পালিত হচ্ছে এ বউ মেলা।
বৈশাখের ২য় দিন থেকে এ বউমেলা শনিবার থেকে শুরু হয়। এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সিদ্ধেশ্বরী বটতলার পদতলে (সনাতন) হিন্দু সম্প্রাদায়ের শত শত নর-নারীরা পহেলা বৈশাখের এ পূজায় অংশগ্রহণ করেন। তবে এবারে রমজান মাস হওয়ায় মেলার আয়োজন ও পরিধি ছিল কম।
আজ সকাল থেকে রমণীর কলহাস্য ও পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে বটতলার বউ মেলা। এ মেলায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ নারী হলেও পুরুষরাও এ মেলায় অংশগ্রহণ করে তবে সংখ্যায় কম। রমণীরা হাতের রিকাবীতে তরমুজ, কাঁঠাল, কলা আম, শশা, বাঙ্গিসহ মৌসুমী ফল নিয়ে লাইন ধরে বটবৃক্ষ তলে ভোগ দিয়ে পূজা আর্চনা করেন। মৌসুমী ফলের স্তুপ পড়ে যায় বট তলায়। ফল দিয়ে পূজা অর্চনা শেষে ভক্তদের মধ্যে প্রসাদরূপে বিতরণ করা হয়।
পহেলা বৈশাখের পরদিন শনিবার পূজার আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শুরু হয় ৩ দিনব্যাপী বউমেলা। মেলায় পূজা অর্চনা ছাড়াও বউ মেলায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এ বউ মেলায় দারু ও মৃৎশিল্পীদের তৈয়ারী নানা রংঙের নানা বর্ণের টেপা পুতুল, হাতি, ঘোড়া, ময়না, টিয়া, বাঘ-ভাল্লুক, হাঁড়ি পাতিল থেকে শুরু করে মণ্ডা মিঠাইয়ের দোকান বসে। বিভিন্ন মনোহারি জিনিস পত্রের পসরা নিয়ে বসে মেলায়।
মৃৎশিল্প, লৌহশিল্প, কাঠ ও বাঁশের তৈরী লোক পণ্য ছাড়াও মেলায় পাওয়া যায় বাহারি মিষ্টান্ন সামগ্রী। সোনারগাঁওয়ের বউমেলা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে একটি। সনাতন ধর্মালম্বীর অনেকের মতে বউ মেলায় পূঁজা অর্চনা করলে পুরনো বছরের স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া বিবাদকে দূরে ঠেলে দিয়ে একজন বধূ যেন স্বামী সোহাগিনী হয়ে উঠে এবং নতুন বছরে স্বামীর সংসারকে ধন ধান্যে ভরে তুলতে পারে। এখানে অনেক ভক্তদের দেবীর নামে পাঠা ও কবুতর উৎসর্গ করতে দেখা যায়।
সনাতন ধর্মালম্বী আবাল বৃদ্ধ বনিতারা তাদের মনের বাসনা পূরণের লক্ষ্যে বট মূলে পূজা অর্চনাসহ বিভিন্ন ফলমূল ও পশু পাখি ভোগ দিয়ে থাকেন। অনেকের বিশ্বাস বটমূলের মাটি শরীরের মাখলে রোগবালাই থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। প্রেমে সফল ও দ্রুত বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার জন্য এ স্থানের মাটি খুবই উপকারী মনে করে এই দিনটিতে সনাতন ধর্মালম্বীর লোকেরা মাটি সংগ্রহ করে থাকে। বউ মেলাকে কেন্দ্র উপজেলার জয়রামপুর, ভট্টপুর, ষোলপাড়া, পানামসহ আশে পাশের সনাতন ধর্মালম্বীর লোকজনদের মধ্যে উৎসবের আমেজে মুখরিত হয়ে উঠে।
মেলায় আসা নববধু আরতী রানী সাহা, রঞ্জিতা দাস ও শিতুলী রানি পাল জানান, সংসারের সুখ শান্তি ও স্বামী সন্তানের মঙ্গল কামনায় আমরা এ মেলায় এসে পূজা করতে এসেছি। বড়দের কাছ থেকে শুনেছি এ মেলায় এসে পূজা আর্চনায় স্বামী সন্তান ও সংসারের কল্যাণ কামনায় সফল হয়। তাই এসেছি এ মেলায়।
পুরোহিত চন্দন ভট্টাচার্য জানান, এ বউ মেলায় সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীরা ভিড় করে সিদ্ধেশ্বরী বটতলায়। এবারে সকালে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পূজা আর্চনা হয়ে মেলা শুরু হয়। এ মেলা পূজা আর্চনা মূলত একদিনে। কিন্তু মেলা জমে ৩ দিন। এ মেলাটি নারী কেন্দ্রীক হলেও এখানে আসেন হিন্দু, মুসলমান সব ধর্মালম্বীর মানুষ। আসেন বিদেশি পর্যটকরাও।
বউ মেলা আয়োজক কমিটির কর্মকর্তা নিলোৎপল রায় জানান, নব রূপে এসো নববর্ষ ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরায় ‘এসো হে বৈশাখ এসো’ নতুন বছর সবার জীবনে মঙ্গল বয়ে আনুক এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে এবারও বর্ষবরণ উৎসবে আমরা সিদ্ধেশ্বরী কলী পূজার আয়োজন করেছি। এবারে মেলা মুসলমানদের রমজান মাস হওয়ায় আয়োজন ছিল কম।
সিদ্ধেশ্বরী বটতলার পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি মানিক ঘোষ জানান, সকলের সহযোগিতায় এ বউ মেলায় পুজা অনুষ্ঠান শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়। সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজওয়ান উল ইসলাম জানান, হিন্দু ধর্মালম্বীদের বউ মেলায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মেলা উপভোগ করতে হিন্দু সম্প্রদায় ছাড়াও মুসলিম ধর্মের লোকজনও অংশ নেয়।