ওয়াশিংটনের কেন্দ্রীয় সরকারের বিচারক জেমস বোসবার্গের অভিশংসন চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কারণ, ভেনেজুয়েলার ২৩৮ নাগরিককে প্রত্যর্পণ দুই সপ্তাহ মুলতবি রাখতে রুলিং দিয়েছিলেন ওই বিচারক। এতে ওই বিচারকের প্রতি ক্ষুব্ধ হন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
মঙ্গলবার সকালে ওই ঘটনায় বিচারকের অভিশংসন চেয়ে নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লিখেন, তিনি একজন ‘বিঘ্ন ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী’।
যদিও ট্রাম্পের পোস্টে সরাসরি বোসবার্গের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে অভিশংসনের জন্য তার দল রিপাবলিকান পার্টির সদস্যরা এরই মধ্যে কার্যক্রমও শুরু করেছেন।
এদিকে, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্বের কারণে কোনও বিচারকের অভিশংসন চেষ্টা নিয়ে সতর্ক করেছেন দেশটির প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস।
এক বিবৃতিতে বোসবার্গের অভিশংসনের প্রস্তাব নিয়ে সতর্ক করে প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস লিখেছেন, “দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এইটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বিচার বিভাগের সঙ্গে কোনো বিষয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে অভিশংসন কোনো সমাধান নয়। [এই রকম কোনো দ্বন্দ্ব দেখা দিলে] স্বাভাবিক আপিল বিভাগ বিষয়টি পর্যালোচনা করবেন।”
প্রধান বিচারপতির পক্ষে বিবৃতিটি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট। দেশটির ইতিহাসে প্রধান বিচারপতির এই ধরনের পদক্ষেপ দুর্লভ।
এর আগে মার্কিন কেন্দ্রীয় বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা গত সপ্তাহে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, তাদের সহকর্মীদের প্রতি প্রশাসনের হুমকি বাড়ছে। রুলিংয়ের জন্য বিচারকদের অভিশংসন চাওয়াকে তারা ‘উদ্বেগজনক’ বলেও বর্ণনা করেছেন।
জানা গেছে, ট্রাম্প প্রশাসন গত শনিবার ভেনেজুয়েলার ২৩৮ নাগরিকসহ মোট ২৬১ ব্যক্তিকে এল সালভাদরে প্রত্যর্পণ করেছে। এসব ব্যক্তিকে এল সালভাদরের একটি উচ্চ নিরাপত্তাসম্পন্ন কারাগারে রাখা হবে। এ জন্য মধ্য আমেরিকার দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থ পাবে।
একই দিন এই ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণ দুই সপ্তাহ মুলতবি রাখতে রুলিং দিয়েছিলেন ওয়াশিংটনের কেন্দ্রীয় সরকারের বিচারক জেমস বোসবার্গ।
গ্যাং দল ট্রেন ডি আরাগুয়া এবং এমএস-১৩ এর সদস্যদের দ্রুত প্রত্যর্পণের জন্য গত শুক্রবার কয়েক শতকের পুরোনো ভিনদেশি শত্রু আইন বা এলিয়েন এনেমিস অ্যাক্ট ব্যবহারের নির্দেশ দেন ট্রাম্প। এটি যুদ্ধকালীন আইন হিসেবে পরিচিত। এই আইন ব্যবহারের বিষয়ে ট্রাম্পের যুক্তি ছিল, ট্রেন ডি আরাগুয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘অনিয়মিত যুদ্ধ’ চালাচ্ছে।
কিন্তু গ্যাং সদস্যদের প্রত্যর্পণে ১৭৯৮ সালের এলিয়েন এনেমিস অ্যাক্ট ব্যবহার নিয়ে আপত্তি করে বিচারক জেমস বোসবার্গ ভিন্ন যুক্তি দেন। তার যুক্তি ছিল, এই আইনে অন্য দেশের দ্বারা সংঘটিত এমন ‘শত্রুতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডকে’ বোঝানো হয়েছে, যা ‘যুদ্ধের সমতুল্য’।
কিন্তু আদালতের রুলিং সত্ত্বেও গ্যাং সদস্যদের প্রত্যর্পণ করা হয়েছে। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশ ও বিচার বিভাগের মধ্যে এক ধরনের সংঘাতের সূচনা হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই সাংবিধানিক সংকট কত দূর গড়াবে সেটা দেখার বিষয়।
এই পরিস্থিতিতে সোমবার জেমস বোসবার্গ বিচার বিভাগের আইনজীবীদের কাছে কিছু বিষয়ে তথ্য জানতে চান। তিনি তাদের প্রশ্ন করেন, গ্যাং সদস্যদের পাঠানো-সংক্রান্ত ট্রাম্পের ঘোষণাটি ঠিক কখন কার্যকর হয়েছিল এবং প্রত্যর্পণের ফ্লাইটগুলো এল সালভাদরের উদ্দেশ্যে কখন রওনা করেছিল?
জেমস বোসবার্গের প্রশ্নের জবাব দিয়ে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও শুল্ক প্রয়োগকারী (আইসিই) কর্মকর্তা রবার্ট সারনা স্থানীয় একটি আদালতকে জানান, শনিবার বিকালে হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে ট্রাম্পের নির্দেশ প্রকাশিত হওয়ার পর আটক ব্যক্তিদের বহনকারী তিনটি উড়োজাহাজ এল সালভাদরের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করে।
তবে আটক ব্যক্তিদের বহনকারী একটি উড়োজাহাজ বোসবার্গের রুলিংয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে গিয়েছিল। শনিবার রাত ৭টা ২৫ মিনিটে বোসবার্গ দুই সপ্তাহের জন্য এই সব গ্যাং সদস্যের প্রত্যর্পণ স্থগিত রাখতে বলেছিলেন। আদালতকে আইসিই কর্মকর্তা রবার্ট সারনা আরও বলেন, আটক ব্যক্তিদের শুধুমাত্র এলিয়েন এনেমিস অ্যাক্টের অধীনে প্রত্যর্পণ করা হয়নি। বরং তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আলাদা অপসারণের নির্দেশ ছিল।
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিনিধিত্বকারী দেশটির বিচার বিভাগের আইনজীবীরা লিখিতভাবে জানিয়েছেন, বিচারকের লিখিত আদেশ প্রকাশিত হওয়ার আগেই ফ্লাইটগুলো যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে গিয়েছিল। তাদের যুক্তি, লিখিত আদেশ প্রকাশের আগে বিচারক আদালতে মৌখিকভাবে যে আদেশ দিয়েছিলেন, তা ধর্তব্য নয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের আইনজীবীদের দাবি, আদালতের লিখিত আদেশ লঙ্ঘিত হয়নি। কারণ সংশ্লিষ্ট ফ্লাইটগুলো লিখিত আদেশের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমা ছেড়ে গিয়েছিলেন। তাই বলা যায়, বিচারকের আদেশ জারি হওয়ার আগেই উড়োজাহাজের আরোহীরা ‘অপসারিত’ হয়েছিল।
এদিকে ট্রাম্পের পোস্টের কয়েক ঘণ্টা পর তার দল রিপাবলিকান পার্টির আইনপ্রণেতা ব্র্যান্ডন গিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক্সে জানিয়েছেন, বোসবার্গের অভিশংসনের কাজ প্রতিনিধি পরিষদে শুরু হয়েছে। তিনি এরই মধ্যে প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউসে বিচারকের বিরুদ্ধে অভিশংসন-সংক্রান্ত ধারাগুলো উত্থাপন করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ তথা প্রতিনিধি পরিষদে কোনও বিচারককে অভিশংসিত করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেলেই চলে। এ ক্ষেত্রে কোনও প্রস্তাব কত ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। নিম্নকক্ষে পাস হওয়ার পর প্রস্তাবটি উচ্চকক্ষ সিনেটে যাবে। বিচারকের অভিশংসনের জন্য সেখানে প্রস্তাবটির পক্ষে অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ ভোট দরকার হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সিনেটে তাদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট নেই। সূত্র: রয়টার্স, ওয়াশিটন পোস্ট, এবিসি নিউজ