বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা সুন্দরবনে কোনওভাবেই থামছে অগ্নিকাণ্ড। গত ২২ বছরে সংরক্ষিত এই ম্যানগ্রোভ বনে ৩২ বার আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়েছে শতাধিক একর বনভূমি। প্রতিবাই আগুন লাগার পর তদন্ত কমিটি গঠন করেই দায়িত্ব সারছে বন বিভাগ। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সুপারিশ বাস্তবায়নে নেই বন বিভাগের কোনও আগ্রহ।
কঠোর মনিটরিংয়ের অভাবে সুন্দর বনে একর পর এক আগুনে বন পুড়ে ছাই হওয়ার জন্য খোদ বন বিভাগকেই দায়ি করছে পরিবেশবাদীরা। সর্বশেষ গোট শনিবার সকাল ১১টায় পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায় আগুন লেগে বন বিভাগের হিসেবেই পুড়ে যায় ৭ দশমিক ৯ একর বনভূমি। ৪৭ ঘন্টা পর সোমবার (০৬ মে) দুপুর সাড়ে ১০টায় আগুন শতভাগ নিয়ন্ত্রনে আসে।
বার বার সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে সামগ্রিক ভাবে পরিবেশের ক্ষতির জন্য বন বিভাগকে দায়ি করে মঙ্গলবার (০৭ মে) অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়কারী মো. নূর আলম শেখ বলেন, গত ২২ বছরে সংরক্ষিত এই ম্যানগ্রোভ বনে ৩২ বার আগুন লেগে বড়গাছসহ লতাগুল্ম মারা জাচ্ছে। প্রাণীকূলের আবাস ও প্রজননস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন্যপ্রাণীরা আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। বনের প্রান-প্রকৃতির শৃংখলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রভাব পড়ে বনের প্রাণীকূলের খাদ্যচক্রে। চরম আঘাত আসে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের উপরে। অসৎ বনকর্মকর্তাদের যোগসাজশে মুনাফালোভী মাছ ব্যবসায়ীরা বারে বারে সুন্দরবনে আগুন লাগাচ্ছে। কাজেই বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে অগ্নিকান্ডের দায়ভার বনবিভাগকেই নিতে হবে।
মোংলা প্রেসক্লাব ‘বার বার আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন, দায় কার, করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, প্রকৃত জেলেরা সুন্দরবনে কখনো আগুন লাগাতে পারেনা। কতিপয় মুনাফালোভী অসৎ মাছ ব্যবসায়ী ও অসাধু বনকর্মতারা মিলে সুন্দরবনে আগুন লাগিয়ে থাকে। অগ্নিকাণ্ডের সাথে যারাই জড়িত থাকুন না কেন আইনের আওতায় এনে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। প্রতি হেক্টর সুন্দরবনের প্রতিবেশসেবার আর্থিকমূল্য ৪৫৬ থেকে ১ হাজার ৯২ মার্কিন ডলার। এই হিসেবে বছরে সুন্দরবন ২৭ কোটি থেকে ৭১ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমান প্রতিবেশসেবা প্রদান করে চলেছে।
সংবাদ সম্মেলনে অগ্নিকাণ্ড বন্ধে সুপারিশ করা হয়। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে অগ্নিকান্ডের কারন জানতে ও অগ্নিকান্ড বন্ধে বনবিভাগসহ অন্যান্য আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য, সুন্দরবন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় জনগণ ও নাগরিক এবং পরিবেশ সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন, ওয়াচটাওয়ার নির্মান, বনের মধ্যে অবাধ যাতায়াত বন্ধ, সুন্দরবনে ইআইএ ব্যতীত অপরিকল্পিত খাল খনন বন্ধ, মৌয়ালদের প্রশিক্ষণ, সুন্দরবন রক্ষায় স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির সুপারিশ করা হয়। এছাড়া সুন্দরবন রক্ষায় ড্রোন ক্যামেরা, সিসিটিভি ক্যামেরাসহ বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশবাদী সংগঠনের মধ্যে সুন্দরবন রক্ষায় আমরা ছাড়াও ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), পশুর রিভার ওয়াটারকিপার, সুন্দরবনের জেলে সমিতির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোহম্মদ নুরুল করিম জানান, কিভাবে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ও জীববৈচিত্র্যের কি ধরনের ক্ষতি হয়েছে এজন্য বন বিভাগের পক্ষ থেকে আলাদা দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিবেশগত পরিবর্তনে জীববৈচিত্র্যের কি ধরনের ক্ষতি হয়েছে ও ভবিষতের করনীয় নির্ধারনে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দোকে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটনে চাঁদপার রেঞ্জে কর্মকর্তা (এসিএফ) রানা দেবকে প্রধান করে তিন সদস্যের গঠিত অপর তদন্তে কমিটি সরেজমিনে তদন্ত কাজ শুরু করেছে। তদন্ত রিপোর্ট পাবার পর কিভাবে আগুন লেগেছে ও জীববৈচিত্র্যের কি ধরনের ক্ষতি হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তরিত জানা যাবে।