বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ৬৫টি সামুদ্রিক প্রজাতির প্রাণী নথিভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রজাতি সম্ভবত বিশ্বের বুকেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে- যা দেশের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য গবেষণায় বড় মাইলফলক। ইএএফ-ন্যানসেন প্রোগ্রাম’র জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
রবিবার (৩০ নভেম্বর) ঢাকার একটি হোটেলে ‘ইএএফ-ন্যানসেন সার্ভে ২০২৫ ফাইন্ডিং অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড ফর সাসটেইনেবল মেরিন ফিশারিজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এই ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বিশ্ব কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং বাংলাদেশ-এফএও অংশীদারিত্বের পাঁচ দশক পূর্তি উপলক্ষ্যে এএফএও, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও নোরাড এই অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজন করে।
মাসব্যাপী এই জরিপটি ২০২৫ সালের ২১ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত হয়। এ জরিপ বাংলাদেশের পুরো সমুদ্রসীমা অর্থাৎ ১ লাখ ১৮ হাআজ্র ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে চালানো হয়। এই মিশনের অংশ হিসেবে গবেষকরা সমুদ্রবিজ্ঞান-সংক্রান্ত পরিমাপ, ফিশারিজ ট্রলিং, প্ল্যাঙ্কটন ও জেলিফিশ গবেষণা এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের নমুনা সংগ্রহের কাজ করেছেন।
এ জরিপের আগে বাংলাদেশে নথিভুক্ত সামুদ্রিক প্রাণীর সংখ্যা ছিল ৪৭৫টি। নতুন ফলাফলের পর এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। নতুন আবিষ্কৃত প্রজাতিগুলোর নাম এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও নিশ্চিতকরণের জন্য নমুনাগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার একটি গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও ইএএফ-ন্যানসেন লেগ-২.৫-এর কো-ক্রুজ লিডার মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন জানান, এবারের জরিপে ৭৩০ মিটার পর্যন্ত গভীর সমুদ্রের তলদেশ অনুসন্ধান করা হয়েছে, যা আগে কখনও করা হয়নি। পূর্বে অনাবিষ্কৃত অঞ্চলগুলোতে জাল ফেলা হয়েছে। এই গভীরতা ও নতুন এলাকা অনুসন্ধানের ফলেই সম্ভবত অজানা নতুন প্রজাতিগুলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
আন্তর্জাতিক এই গবেষণা কার্যক্রমে ৪০ সদস্যের একটি দল অংশ নেয়। এতে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, নরওয়ে ও এফএওর সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা কাজ করেছেন। তারা ব্যাপকভাবে জৈবিক নমুনা সংগ্রহ, প্রজাতির নথিকরণ ও লার্ভা শনাক্তকরণের কাজ করেছেন।
শুধু প্ল্যাঙ্কটন নমুনার জন্যই ৩২টি স্টেশন বা স্থানে জরিপ চালানো হয়, যেখান থেকে ৯ হাজার ৭৯৪টি মাছের লার্ভা (টুনা মাছের লার্ভাসসহ) সংগ্রহ করা হয়েছে। একইসাথে গবেষক দলটি ৪১৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা সংগ্রহ করেছে। প্রতিটি ট্রল স্টেশনেই জেলিফিশের উপস্থিতি পাওয়া গেছে; এই জরিপেই প্রথমবারের মতো জেলিফিশের বিস্তৃতি ও প্রাচুর্য ম্যাপ করা হয়েছে।
ফলাফল ঘোষণা অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ২০১৮ সালের অভিযানের তথ্যের সঙ্গে এই নতুন জরিপের ফলাফল যুক্ত হয়ে ভবিষ্যতের মৎস্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, সম্পদ সংরক্ষণ কৌশল এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি সামুদ্রিক নীতি প্রণয়নে সহায়ক হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সামুদ্রিক বিজ্ঞান সক্ষমতা জোরদার করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞরা একটি আধুনিক গবেষণা জাহাজের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন এবং সরকার সেই লক্ষ্য অর্জনে চেষ্টা করবে।
বাংলাদেশে এফএও-এর প্রতিনিধি জিয়াওকুন শি বলেন, ‘বাংলাদেশের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর একটি যৌথ যাত্রার ফল—যা সর্বদা এদেশের জনগণ, উদ্ভাবক ও অংশীদারদের দ্বারা চালিত। একটি সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে আমরা প্রয়োজনীয় শক্তি, ধারণা ও সহায়তা নিয়ে একসাথে এগিয়ে যাচ্ছি।’
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের, নরওয়েজীয় রাষ্ট্রদূত হকন আরাল্ড গুলব্রান্ডসেন ও মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ। এ জরিপ টেকসই সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ উল্লেখ করে তারা বলেন, এটি বাংলাদেশি সামুদ্রিক বিজ্ঞানীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।

