২০২৫ সালের উত্তাল সময় পার করে মার্কিন অর্থনীতি টিকে গেলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফেরেনি। বছরজুড়ে বাণিজ্য যুদ্ধ, শেয়ার বাজারের অস্থিরতা এবং ইতিহাসের দীর্ঘতম সরকারি অচলাবস্থার মতো নানা নাটকীয়তা সত্ত্বেও মার্কিন অর্থনীতি অনেক পূর্বাভাসের আশঙ্কার চেয়েও বেশি স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করেছে।
তবে এই স্থিতিস্থাপকতা আর সুদিন যে এক নয় তা মার্কিন নাগরিকদের বর্তমান অবস্থাই বলে দিচ্ছে। অধিকাংশ আমেরিকানই ২০২৬ সালে পা রাখছেন এক বুক দুশ্চিন্তা নিয়ে, কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ, আর্থিক টানাপোড়েন আর আগামী দিনে পরিস্থিতি উন্নয়নের সম্ভাবনা নিয়ে এক ধরনের গভীর সংশয় তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
দীর্ঘদিন সরকারি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় স্থবির হয়ে পড়া অর্থনৈতিক তথ্যপ্রবাহ গত সপ্তাহে পুনরায় শুরু হয়েছে। যদিও এই প্রতিবেদনগুলোতে কিছুটা বিভ্রান্তিকর তথ্য পাওয়া গেছে, তবে সব মিলিয়ে চিত্রটি এমন যে মার্কিন অর্থনীতি এখনো এক অস্বস্তিকর অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে আছে। নভেম্বরে কর্মসংস্থানের হার সন্তোষজনক থাকলেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বেকারত্ব। খুচরা বিক্রি স্থিতিশীল থাকলেও মজুরি বৃদ্ধির গতি ছিল মন্থর। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও তা এখনো সহনীয় মাত্রার বাইরেই রয়ে গেছে। গত বসন্তে অনেক অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে দেশ ভয়াবহ মন্দা বা লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কবলে পড়বে। সেই চরম বিপর্যয় না ঘটলেও অর্থনীতির ধীরগতির অবক্ষয় সাধারণ মানুষকে ভোগাচ্ছে। সরকারি তথ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির উজ্জ্বল চিত্র দেখা গেলেও জনমত জরিপে উঠে আসছে ভিন্ন চিত্র। সাধারণ মানুষ বলছেন, জীবনযাত্রার আকাশচুম্বী ব্যয়ের চাপে তারা পিষ্ট এবং এই প্রবৃদ্ধির সুফল কেবল মুষ্টিমেয় ধনী পরিবারই ভোগ করছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি এক ভাষণে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পূর্বসূরিদের দায়ী করে এক ‘স্বর্ণযুগের’ স্বপ্ন দেখালেও বাস্তব চিত্র বেশ কঠিন। শুল্কের কারণে মূল্যস্ফীতির বড় বিস্ফোরণ না ঘটলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য বাড়ি কেনা এখনো সাধ্যের বাইরে রয়ে গেছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুৎ বিল ও স্বাস্থ্য বীমার খরচ। জো বাইডেনের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিদার বাউশির মতে, অর্থনীতির মূল শক্তি নির্ভর করে সাধারণ মানুষের কেনাকাটার সক্ষমতা এবং সুযোগের ওপর। যা বর্তমানে অনুপস্থিত। সাধারণ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কেবল পরিসংখ্যানে ঢেকে রাখা সম্ভব নয় বলেই তিনি মনে করেন।
ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরার শুরুর মাসগুলো ছিল বেশ অস্থির। ইলন মাস্কের ফেডারেল কর্মী ছাঁটাই কর্মসূচি এবং দফায় দফায় শুল্ক আরোপের হুমকিতে শেয়ার বাজারে বড় ধরনের ধস নামে। তবে ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত কিছু শুল্ক নীতি থেকে সরে আসায় বড় ধরনের মন্দা এড়ানো গেছে। এর পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির বিপুল বিনিয়োগ এবং ডাটা সেন্টার তৈরির কর্মযজ্ঞ মার্কিন অর্থনীতিকে এক অভাবনীয় শক্তি যুগিয়েছে। তবে এই প্রযুক্তিনির্ভর প্রবৃদ্ধির সুফল কেবল বিত্তবানদের পকেটে যাচ্ছে। শ্রমবাজারের এই অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীরা, সদ্য স্নাতক পাশ করা তরুণরা। কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীদের মধ্যে বেকারত্বের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে ৮.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা অনেক বিশেষজ্ঞের মতে একটি বড় সংকটের পূর্বাভাস।
আগামী বছর নিয়ে অনেক অর্থনীতিবিদ কিছুটা আশাবাদী হলেও শঙ্কার মেঘ এখনো কাটেনি। নতুন কর ছাড় নীতি এবং ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমানোর ফলে বাজারে কিছুটা গতি ফিরতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে নীতিগত অনিশ্চয়তা কমে এলে ব্যবসায়ীরা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হতে পারেন। তবে এই আশাবাদ নির্ভর করছে মূলত এআই খাতের সাফল্যের ওপর। যদি এই খাতের জোয়ারে ভাটা পড়ে কিংবা ট্রাম্পের নতুন কোনো শুল্ক নীতি বাজারকে অস্থির করে তোলে, তবে পরিস্থিতি আবারও জটিল হতে পারে। সিটি গ্রুপের অর্থনীতিবিদদের মতে, মজুরি বৃদ্ধির হার যদি আরও কমে যায়, তবে কর ছাড় বা সুদের হারের সুবিধা খুব একটা কাজে আসবে না। দিনশেষে কর্মসংস্থানই হবে ২০২৬ সালে মার্কিন অর্থনীতির আসল চালিকাশক্তি।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

