সংকটে সক্ষমতা হারাচ্ছেন করদাতারা

0
সংকটে সক্ষমতা হারাচ্ছেন করদাতারা

শত শত কারখানা বন্ধ। অনেক কারখানায় ভাঙচুর করা হয়েছে, দেওয়া হয়েছে আগুন। নেই উৎপাদন। বেকার লাখো শ্রমিক। হারিয়ে গেছে প্রাণচাঞ্চল্য। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভঙ্গুর দশা। নিয়ন্ত্রণের বাইরে পরিস্থিতি। আসছে না নতুন বিনিয়োগ। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে হাহাকার। চাপে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তারতম্য দেখা গেছে চাহিদা ও ভোগে। ফলে গতি হারিয়েছে অর্থনীতি। 

এসবের প্রভাব পড়েছে দেশের রাজস্ব আয়েও। এবার ঠিকমতো কর দিতে পারছেন না করদাতারা। যাঁরা এবার বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন, তাঁদের শতকরা ৮৮ ভাগই দিয়েছেন ‘শূন্য কর’। মানে এঁরা কোনো কর দিতে পারেননি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

তথ্য বলছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ই-রিটার্ন জমা দিয়েছেন ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৩৭ জন। এর মধ্যে শুধু রিটার্ন জমা দিয়েছেন অথচ কোনো টাকা জমা দেননি ১০ লাখ ২৫ হাজার ১০৯ জন, যা মোট রিটার্নের ৮৮.৪৪ শতাংশ। অন্যদিকে অন্তত ন্যূনতম কর দিয়েছেন এক লাখ ৩৩ হাজার ৯২৮ জন। এই সংখ্যা মোট জমা হওয়া রিটার্নের ১১.৫৬ শতাংশ। এতে আয়কর আদায় হয়েছে অত্যন্ত নগণ্য- ৮৯ কোটি ৭৮ লাখ ৮০ হাজার ৪৩২ টাকা।

পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশের প্রায় ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। আর পরোক্ষভাবে নির্ভরতার সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। অথচ গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে মোট ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফলে বেকার হয়ে গেছেন এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক। পোশাক খাত ছাড়াও বিগত সময়ে আরো অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কর্মহীন হয়েছেন অনেক মানুষ। তাঁদের মধ্যে কর্মকর্তা পর্যায়ের অনেকেরই ছিল করযোগ্য আয়।

ফলে যে ব্যক্তি আগে কর দিতেন, এখন তিনিই শূন্য কর দিচ্ছেন। সাভারের একটি পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ায় অর্থবছরের প্রায় আট মাস কর্মহীন ছিলেন রবিউল হাসান। বাকি চার মাসে তাঁর করযোগ্য আয় না থাকায় তিনি শূন্য কর দিয়েছেন। অথচ এর আগের করবর্ষে তিনি ন্যূনতম করের চেয়েও বেশি কর দিয়েছিলেন। শুধু রবিউলই নন, এমন করদাতার সংখ্যা অনেক। শূন্য করের অনুপাত দেখলেই তা স্পষ্ট। শুধু যে করখানার কর্মকর্তারাই চাকরি হারানোর কারণে কর দিতে পারছেন না তা নয়; ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণেও অনেক করদাতার আয় কমে গেছে বলে জানা যায়। ফলে তাঁরাও কাঙ্ক্ষিত কর দিতে পারছেন না।

যদিও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন এই সংখ্যা খুবই কম। শূন্য কর যাঁরা দিচ্ছেন তাঁদের সবার শূন্য কর না-ও হতে পারে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ই-রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার পর মানুষ রিটার্ন জমা দিচ্ছে, এটা একটি ভালো দিক। তবে এত বড়সংখ্যক শূন্য করের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। অনেকেই হয়তো কম আয়ের জন্য শূন্য কর দিচ্ছেন। কিন্তু অনলাইনে যাঁরা রিটার্ন জমা দিচ্ছেন, সবার ক্ষেত্রে এই তথ্য সঠিক না-ও হতে পারে। দেশের হাউসহোল্ড ইনকাম এক্সপেন্ডিচার সার্ভের (খানা আয় ও ব্যয় জরিপ) তথ্যের সঙ্গে এই রিটার্নের সংখ্যাগত পার্থক্য রয়েছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে শূন্য করদাতাদের তথ্য যাচাই করা উচিত। তাঁদের লেনদেন যাচাই করেও রিটার্নের সঠিকতা যাচাই করা যাবে।

দেশে এখন পর্যন্ত নিবন্ধিত করদাতা আছেন এক কোটি ২৩ লাখ। সে হিসাবে এখনো অনেক করদাতার রিটার্ন জমা দেওয়া বাকি আছে। তবে নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারেন। ২০২৫-২৬ করবর্ষে সবার জন্য ই-রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে গত বছর দেশের কয়েকটি সিটি করপোরেশন এলাকার সব সরকারি কর্মচারী, সব তফসিলি ব্যাংক, মোবাইল টেলিকম প্রতিষ্ঠান, ইউনিলিভার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ম্যারিকো, বার্জার পেইন্টস, বাটা শু ও নেসলেতে কর্মরত সব কর্মচারীকে ই-রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তাতে অনলাইনে রিটার্ন জমা পড়েছিল ১৭ লাখ। আর মোট রিটার্ন জমা পড়েছিল ৪৫ লাখ।

এ বছর বেশির ভাগ করদাতাকে আয়করের আওতায় আনতে চায় এনবিআর। এখন পর্যন্ত রিটার্ন জমার সংখ্যা কম। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা কেমন হতে পারে, এ প্রসঙ্গে এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত শেষ সময়ে রিটার্ন বেশি পড়ার একটা প্রবণতা থাকে। এ ছাড়া এ বছর অনেক নতুন করদাতা নিবন্ধন নিয়েছেন। তাঁরা আসছে ৩০ জুন পর্যন্ত স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে তাঁদের রিটার্ন জমা করতে পারবেন। সব মিলিয়ে গত বছরের তুলনায় এ বছর রিটার্ন দাখিলের পরিমাণ বাড়বে।

শূন্য করের হার এত বেশি কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, শূন্য কর নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহু ভুয়া প্রচার-প্রচারণা হয়েছে। অনেকে বুঝে না বুঝেই রিটার্ন জমা দিয়েছেন। মিথ্যা তথ্য দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যাঁরা না বুঝে শূন্য কর দিয়েছেন তাঁরা সংশোধনী রিটার্ন পূরণ করে এখনো নতুন করে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন।

ই-রিটার্ন ব্যবহারের মাধ্যমে আয়কর অফিসে যাতায়াত ও অন্যান্য ভোগান্তি থেকে মুক্ত হয়েছেন করদাতারা। তবে ই-রিটার্ন ব্যবহারেও কিছু সমস্যার মধ্যে পড়ছেন অনেকে। সার্ভারের দুর্বলতা, মোবাইলে ওটিপি আসতে দেরি হওয়া, রেজিস্ট্রেশনে বিড়ম্বনা, রিটার্নের ফাইনাল প্রিভিউ ডাউনলোডে সমস্যা, গত বছর অফলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার পর অনলাইনে রেজিস্টার না করা, কল সেন্টারে ফোন দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়ার অভিযোগ তাঁদের।

সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here