দিনাজপুরের লিচুর বাগানগুলো মুকুলে মুকুলে ভরে গেছে। লিচু বাগানগুলোতে এখন মৌ মৌ গন্ধ। আর এই গন্ধে মাতাল হয়ে মৌমাছিরা এগাছ থেকে ওগাছে উড়ে সংগ্রহ করছে মধু।
সুস্বাদু, মিষ্টি এ মধু মৌমাছির মাধ্যমে আহরণ করছেন মৌ-চাষিরা। এতে বাগানিরা ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হচ্ছেন। গত বছর প্রায় ৪৫কোটি টাকার মধু আহরণ হয়েছে। এবার দিনাজপুর অঞ্চলের লিচুর মুকুল থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার মধু উৎপাদন সম্ভব হবে বলে আশা করেন উত্তরবঙ্গ মৌ চাষি সমিতির সদস্য মোসাদ্দেক হোসেন।
মোসাদ্দেক হোসেন জানান, ‘দিনাজপুর জেলায় যে পরিমাণ লিচু বাগান আছে, এটা যদি সুশৃঙ্খল অবস্থায় গাণিতিক আকারে পরিচালনা এবং মৌখামারিদের সেভাবে বিন্যস্ত করা যায় তাহলে দিনাজপুর থেকে শত কোটি টাকার মধু আহরণ করা সম্ভব রয়েছে। এজন্য এখানে একটি মৌ-গবেষণাগার স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি। মৌ-গবেষণাগার স্থাপন করা যায় তাহলে দিনাজপুরকে মধুর জেলায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’
দিনাজপুর সদরের আউলিয়াপুর ইউপির মাশিমপুর এলাকার লিচুবাগানে ১০০ মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করছেন মোসাদ্দেক হোসেন। প্রতি সপ্তাহে বাক্স থেকে মধু আহরণ করতে হয়। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে চাকরির পিছনে না ছুটে মৌ-খামার গড়ে মধু উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছেন তিনি। অল্প সময়ে মৌ-চাষেই হয়েছেন স্বাবলম্বী।
মোসাদ্দেক হোসেন জানান, কাঠের বাক্সে তিন ধরনের মৌমাছি থাকে মৌচাকে। রানি, পুরুষ আর শ্রমিক মাছি। ২-৩ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে রানি। পুরুষ মৌমাছিরা বাঁচে দেড় মাস। শ্রমিকেরা বাঁচে এক মাস। পুরুষ মৌমাছির হুল নেই এবং সবচেয়ে অলস। এরা শুধু প্রজননে অংশ নেয়। মৌচাকের সবচেয়ে কার্যক্ষম হলো শ্রমিক মাছি। চাক তৈরি, মৌচাক পরিষ্কার করা, মৌ শিশুর লালন, রানি তৈরি, রানির জন্য বিশেষায়িত রয়াল নামক জেলি উৎপাদন, খাবার সংগ্রহ, নিরাপত্তার মত কাজগুলো শ্রমিক মৌমাছিরাই করে থাকে। কাঠের বাক্সে ৮ থেকে ১০টি মৌচাক থাকে। প্রতি চাকে রানির সংখ্যা মাত্র একটি। নতুন রানির সৃষ্টি হলে চাক পৃথক হয়ে যায়। ষড়ভূজাকার মৌ ঘরগুলো করা হয়। মধু উৎপাদিত হয় উপরে, নিচের দিকে বাচ্চা তৈরির জন্য রানি ডিম পাড়ে।
তিনি জানান, মওসুমে একটি বাক্সসহ বিভিন্ন খরচ হয় মোট ৩ হাজার টাকা। এরপরেও কেউ আন্তরিকতা, ধৈর্য্য নিয়ে পুঁজি বিনিয়োগ করলে লাভ হবেই। লোকসান হবে না বলে জানান তিনি। লিচুর মুকুল ছাড়াও সরিষা, কালোজিরা, ধনিয়া, লিচু, মিষ্টি কুমড়া, তিল, সাজিনা, কেওড়া, গেওয়া, ধঞ্চা থেকেও উৎপাদিত হয় মধু।
উত্তরবঙ্গ মৌচাষী সমিতির সদস্য মোসাদ্দেক হোসেন আরও জানান, মধু চাষ লাভজনক। মধুচাষের মাধ্যমে দেশ থেকে বেকার সমস্যা দূর করা যেতে পারে। বিশ্ব বাজারে মধুর প্রচুর চাহিদা থাকায় রপ্তানি করা গেলে দেশ অর্জন করবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
মৌখামারি মোমিনুল ইসলাম জানান, দিনাজপুর অঞ্চলে লিচুর মুকুল থেকে মধু আহরণে কাজ করছেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ৪০০-৪৫০জন মৌচাষি। প্রতি মেট্রিক টন মধু পাইকারী বিক্রি হয় আড়াই লাখ টাকায়।
দিনাজপুর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক)’র উপ-মহব্যবস্থাপক প্রকৌশলী গোলাম রব্বানী জানান, দিনাজপুরের জেলায় চার শতাধিক মৌ-খামারি মওসুমে মধু সংগ্রহ করছেন। লিচু বাগানে মৌচাষ করে মৌচাষিরা যেমন মধু চাষ করে লাভবান হচ্ছেন অপরদিকে মৌমাছির মাধ্যমে মুকুলে মুকুলে পরাগায়ন ঘটায় লিচুর ফলনও ২৫ভাগ বেশি হয়। এতে বাগানিরা ও মৌচাষি উভয় লাভবান হচ্ছেন। বেকারত্ব যেমন দূর হচ্ছে, তেমনি লিচুর ফলনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উল্লেখ্য, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, দিনাজপুর জেলায় ৫হাজার ৭৮৭হেক্টর জমিতে লিচু চাষ করা হয়েছে। যা গতবারের তুলনায় ২৮০হেক্টর বেশি। লিচুবাগান আছে ৫৪১৮টি।