ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ চলছে। এই ইস্যুতে বেশ কয়েক বছর ধরেই রাজপথে এবং গণমাধ্যমে সোচ্চার ছিলেন হাসনাত কাইয়ুম। তিনি গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক। বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন রাজু আহমেদ ও মাহফুজ জুয়েল-
বাংলাদেশ প্রতিদিন : কাইয়ুম ভাই, আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই আলোচনায়।
হাসনাত কাইয়ুম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আমি প্রথমেই আপনার কাছে জানতে চাইব, ৫৩ বছর আগে বাংলাদেশ একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হলো, মাত্র পঞ্চাশ বছর পরেই কেন এই রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে?
হাসনাত কাইয়ুম : আপনাকে ধন্যবাদ। প্রথমেই আপনাকে বলতে চাই যে, এখানে আমাদের একটা অস্পষ্টতা কাজ করে। ১৯৭২ সালেও এই অস্পষ্টতা ছিল। আমরা যেটা মনে করেছিলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা, তাঁদের যে অবস্থান, এইটা ছিল আমাদের এখানকার মূল সমস্যা। কারণ একাত্তর সালের যুদ্ধের ভেতর দিয়ে তাদেরকে সরিয়ে দেয়ার পর, আমাদের ভূখণ্ডে নিজেদের স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমরা মনে করেছি যে, আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন আমরা নিজেদের মতো করে বাঁচবো। আমাদের লোকেরা যদি আমাদের শাসন করে তাহলে আর কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু আমরা বাহাত্তর সালে যে সংবিধান প্রণয়ণ করলাম, সেই সংবিধানে চলতে গিয়ে ৭৩ থেকে আমরা যে শাসনটা চলতে শুরু করতে দেখলাম এবং আরো পরে ৫৩ বছর ধরে যে শাসনটা আমরা চলতে দেখলাম, তাতে দেখলাম, এটা পাকিস্তানি যে শাসক, কিংবা তারও আগে ব্রিটিশদের যে শাসন, সেই শাসনেরই এক ধরনের বিকশিত রূপ। বিকশিত মানে নিকৃষ্টভাবে আরো, ব্রিটিশ আমলের চাইতে পাকিস্তান আমলে দমনটা আরো বেড়েছে। পাকিস্তানের চাইতে বাংলাদেশে ৫৩ বছরে ধারাবাহিকভাবে দমন-পীড়ন-লুণ্ঠন উত্তরোত্তর বেড়েছে। আগের চাইতে আরো দৃঢ় হয়েছে। এটার একটা বড় কারণ ছিল রাষ্ট্রের কাঠামো–ব্রিটিশদের যে বানানো কাঠামো ছিল, পাকিস্তান আমলেও সেই কাঠামোটা বহাল ছিল। বাংলাদেশ আমলেও, যুদ্ধের পর যখন আমরা রাষ্ট্র বানাতে গেলাম, তখন পর্যন্ত আমরা সেই কাঠামোতে আমরা হাত দেই নাই। সেই ক্ষমতা কাঠামোতে হাত না দেয়ার কারণে স্বাধীনতার যে সুফল আমাদের মানুষের পাওয়ার কথা ছিল, যে আকাঙ্ক্ষা থেকে আমরা যুদ্ধটা করেছিলাম, যেরকম রাষ্ট্র বানানোর কথা ১০ এপ্রিল ঘোষণা করেছিল; দেশে একটা সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচারের রাষ্ট্র বানাবে, সেই রাষ্ট্রটা আসলে কার্যত হয়ে উঠলো না। এটা আমরা যখন উপলব্ধি করি তারপর থেকে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের যে প্রয়োজনীয়তা সে বিষয়ে লেখালেখি শুরু করি। সংবিধানটাকে পর্যালোচনা করে আমরা দেখাই যে, এই ৭২-এর সংবিধানের মধ্যে আসলে পাকিস্তানের সংবিধানটা রয়ে গেছে। কিংবা ব্রিটিশের সংবিধানের যে ক্ষমতা কাঠামো, ওই একই কাঠামো, একই ক্ষমতা রয়ে গেছে। সেইটাকে পরিবর্তন করতে হবে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষার সাথে আসলে এই ক্ষমতা কাঠামোর কোনো সাযুজ্য নেই। বরং বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী যাতে ক্ষমতা কাঠামোটাকে সাজানো যায়, সেজন্য আমরা প্রথমে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব করি ২০১৩ সালে। তার পর ধারাবাহিকভাবে আসতে আসতে আমরা রাষ্ট্রচিন্তা গঠন করি। রাষ্টচিন্তার ভেতর দিয়ে এই আলাপটাকে আরো বাইরের দিকে নিয়ে যাই। এটা এক পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নামে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর গণতন্ত্র মঞ্চ, বিএনপির সাথে জোট; এসবের ভেতর দিয়ে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে সামনে নিয়ে আসি। এবং ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর এখন রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি বাংলাদেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি যে অভ্যুত্থানের কথা বলছেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আমাদের দেশে হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র সংস্কারের যে প্রশ্নটি আপনারা সামনে এনেছেন, এই অভ্যুত্থানের পরে বিজয়ী যেই পক্ষ, অর্থাৎ বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ বা অধিকাংশ রাজনৈতিক দল- এই রাজনৈতিক দলের মধ্যেই তো অনেকে আছেন, যারা আপনি যে কাঠামোর সংকটের কথা বলছেন, সেই কাঠামোটাকে শক্তিশালী করা বা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল। অনেকগুলো রাজনৈতিক দল এরমধ্যে যুক্ত আছে। তো এই রাজনৈতিক দলগুলোকে সাথে নিয়ে বা তাঁদের প্রধান ভূমিকায় অটুট রেখে সেই কাঠামোর সংস্কার কতটুকু সম্ভব?
হাসনাত কাইয়ুম : এইটা আসলে তারা তো চাইবে না। কারণ প্রত্যেকের জন্য এখানে যে ৫৩ বছর ধরে এই শাসন কাঠামোটা ছিল, এর তো একটা বেনিফিশিয়ারি গ্রুপ আছে। রাজনৈতিক দল আছে। এখানকার প্রশাসন আছে। ব্যবসায়ীরা আছে। মাফিয়ারা আছে। ওরা তো কেউ চাইবে না রাষ্ট্রের ওই কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হোক। কিন্তু এই কাঠামোর পরিবর্তনের প্রয়োজনটা এখন আমাদের ছাত্ররা বোঝে। আমাদের সাধারণ জনগণ বোঝে। দেশের আশি ভাগ মানুষ বোঝে। এই আশি ভাগ মানুষকে উপেক্ষা করে এই সমস্ত রাজনৈতিক দলের পক্ষে এখন আর রাজনীতি করা সম্ভব না। সেইজন্য আমরা দেখছি যে, যেই দলটা কার্যত এই পরিবর্তন চায় না, তারাও কিন্তু আন্দোলনে যখন জনগণকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন এসেছে, তখন কিন্তু হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের সময়েই আমরা গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে সরকার এবং শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা বলেছি। এবং এই দাবির সাথে তখন বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলও এসে একাত্মতা ঘোষণা করেছে, যা পরে তাঁদের ৩১ দফায় রাষ্ট্র মেরামতের দাবি হিসেবে বলেছে। তার মানে আপনি চান কি না চান, সব সময় সব কিছু আপনার চাওয়ার ওপর নির্ভর করে না। আপনাকে যদি জনসম্পৃক্ত থাকতে হয়, জনগণকে সাথে নিয়ে, তাদের মন জয় করার জন্য যদি আপনার রাজনীতি করতে হয়, জণগণ যদি আসলেই কোনো ব্যাপার হয়, তাহলে তাদেরকে উপেক্ষা করে রাজনীতি করা সম্ভব না। আর বাংলাদেশে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর থেকে এটা আরো সম্ভব নয়। এটা এখন অনেক কঠিন যে, জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে একটি রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র তাঁর নিজের চাওয়া অনুযায়ী রাজনীতি করে যাবে, এরকম অবস্থাটা আর নেই। আপনি যে রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেছেন, আপনি এখন তাঁদের স্লোগান দেখেন। একটা সময় পর্যন্ত তাঁদের স্লোগান দেখেন এবং এখন দেখেন। একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির এজেণ্ডা দেখেন, আলোচনার বিষয় দেখেন আর এখন দেখেন। বিষয়টা পালটে গেছে। এবং ৫ তারিখ (আগস্ট) থেকে এটা পুরোপুরি পালটে গেছে। এখন বাংলাদেশের প্রধান এজেণ্ডা হচ্ছে, রাষ্ট্রের কী কী সংস্কার হবে। কীভাবে সংস্কার হবে। কেউ এটা বলতে পারবে না যে, কোনো সংস্কার হবে না। কেউ হয়তো বলবে, শুধু নির্বাচনের অংশটা সংস্কার হবে। কেউ হয়তো বলবে, প্রশাসনের সংস্কারটা হলেই আপাতত হয়। সকল সংস্কার এ সরকার আসলে করতে পারবে না। কিংবা কারা সংস্কার করবে? এটা তো এরা করতে পারবে না এ ধরনের আলাপ। কিন্তু সংস্কার লাগবে না, সংস্কার করবো না, এই কথা বলে বাংলাদেশে আর রাজনীতি করা সম্ভব না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি যে সংস্কারের কথা বলছেন, আপনি সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বা পরেও বলা হয়েছে যে, সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যাতে রাষ্ট্রের মধ্যে ঘটে, আপনিও মুক্তিযুদ্ধের সেই রেফারেন্স দিয়েই বলছেন, মানুষ যে প্রত্যাশা করে দেশ স্বাধীন করেছিল, পরবর্তীতে আমরা আসলে সেই পাকিস্তানি কাঠামোর মধ্যেই বন্দি হয়ে যাই। এখনকার যেই রাজনৈতিক ভারসাম্য, তার মধ্যে যদি সংবিধান বা রাষ্ট্র সংস্কার হয়, এখন মুক্তিযুদ্ধের সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর মতো পরিস্থিতি আছে কিনা?
হাসনাত কাইয়ুম : আমরা তো মনে করি মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটা বাস্তবায়ন হয়নি বলেই বার বার আন্দোলন করতে হচ্ছে। সাম্যের রাষ্ট্র যদি হতো, মানুষের মর্যাদার রাষ্ট্র যদি হতো, সামাজিক ন্যায়বিচারের রাষ্ট্র যদি হতো, যেটা আসলে একাত্তর সালে বলা হয়েছিল করা হবে; সেটা তো হয়ই-নি, এখানে তো এমনকি নির্বাচন করার মতো ব্যবস্থাও থাকেনি!
এখানে ব্যাংকে মানুষ টাকা রেখেও নিরাপত্তা পায়নি, তা নিরাপদ থাকেনি। এখানকার প্রশাসন, পুলিশের কাছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আপনি নিরাপত্তা চাইবেন? কারণ
তারাই তো আসলে গুম-খুন সমস্ত কিছুর সাথে যুক্ত ছিল। তার মানে, পুরো রাষ্ট্রটা, একাত্তর সালে যে কারণে যুদ্ধটা করলো, তার উল্টোদিকে চলে যেতে থাকলো। এবং ক্রমাগত যেতে যেতে ৫৩ বছরে বিপরীত দিকে, অনেক দূর চলে গেছে। তো সেইটাকে ফিরিয়ে, আবার এই যে বৈষম্যটা দূর করার যে আকাঙ্ক্ষা, মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যে আকাঙ্ক্ষা, মানুষের ভোটাধিকার কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে আকাঙ্ক্ষা, এটাই তো মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তো সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্যই তো এই অভ্যুত্থান। তাহলে একটা আরেকটার সাথে কোনোভাবেই বিপরীত নয়, বরং আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ওই একই অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এখনো আমাদের রক্ত দিতে হচ্ছে। এবং এখনো আলাপ করতে হচ্ছে যে, আমাদের কোন কোন জায়গা পরিবর্তন করতে হবে। এটা আমাদের ৭২ সালের সংবিধানের মধ্যেই হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কারণ আমরা অনেক মানুষ যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে সেটা করেছিলাম। সেটা তখন হয় নি। হয় নি বলে এখনো হবে না, এটা তো হতে পারে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই যে বাহাত্তর সালের সংবিধানের প্রসঙ্গটা আপনি তুললেন, সেই সংবিধানের ঘাটতিগুলো কী কী? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাগুলো এ সংবিধান কেন ধারণ করতে পারেনি?
হাসনাত কাইয়ুম : আসলে ব্যাপারটা অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। আমাদের সংবিধানে দুটি অংশ আছে। সহজভাবে যদি বলি, এর একটি হচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্রটা ঠিক কী করবে তার আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা একভাবে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। এটা প্রধানত সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়, যেখানে মূলত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলে একটা অধ্যায় আছে। রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে_ এটা বলা আছে চতুর্থ অধ্যায়ে। সংবিধানের প্রধান মূলনীতির মধ্যে এখানে বলা আছে যে, গণতন্ত্র থাকবে। কিন্তু এই সংবিধানে ক্ষমতাটা এভাবে বণ্টন করা আছে যে, রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা একজনের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। এবং যার কাছে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তিনি কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। শুধু তা-ই নয়, তিনি সংবিধানের অধীনেও থাকেন না। তিনি আসলে সংবিধানের ঊর্ধ্বে বা উপরে উঠে পড়েন। তার মানে, তিনি সংবিধানের ওপরে থেকে সারাদেশকে শাসন করেন। রাজাদের মতো কিংবা আরো বেশি ক্ষমতা নিয়ে। কিন্তু এটাকেই আমরা বলি যে, এটা নাকি গণতন্ত্র! এরকম অনেক প্রবল বিপরীতমুখী অনুষঙ্গ রয়েছে। ধরেন, নির্বাচনের কথা। গণতন্ত্রের একটি অন্যতম প্রধান কথা হচ্ছে, আপনি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে ১২৩-এর ৩-এ এটা রাখা হলো যে, যারা সরকারে বা ক্ষমতায় থাকবে, তারা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করবে। এবং সেই সরকারের ক্ষমতাটা তাঁর কাছে যেভাবে থাকে, সেখানে কোনো রাজনৈতিক দল কোনোদিন সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমে সরাতে পারে না। তাইলে যেটা হয়, সরানোর প্রশ্ন যখন ওঠে, তখন হয় ক্যু, না হয় পালটা ক্যু, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, অভ্যুত্থান_ কোনো না কোনো একটা বল্প্রয়োগ লাগে। যখন বল্প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো একটি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হয়, তখন রাজনীতিটা হয়ে পড়ে একটা বল্প্রয়োগের মাধ্যম। এবং যে দল যতো শক্তি ধারণ করতে পারে, সে যতো বেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করতে পারে, বল্প্রয়োগ বা শক্তি প্রদর্শন করতে পারে, তাঁর কাছে ততো বেশি ক্ষমতা থাকে। এবং সেটাই রাজনৈতিক চর্চার অন্যতম বিষয় হয়ে পড়ে। তাহলে শুধু নির্বাচনের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের গণতন্ত্রের পুরো বারোটা বেজে গেছে। আসেন বিচার বিভাগ প্রসঙ্গে, মানুষ একটি জায়গায় গিয়ে বিচার চাইবে, কিন্তু এই বিচার বিভাগও প্রধান নির্বাহীর অধীনে চলে যায়। ধরেন সংসদের কথা, আপনি আইন প্রণয়ন করবেন, কিন্তু এখানে এরকম আইন তৈরি করা যায় যে, আপনি সরকারের অংশ হিসেবে এক টাকার জিনিস এক শো টাকায় কিনবেন, না এক হাজার টাকায় কিনবেন, সেটা আপনাকে কোথাও কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। এরকম ইনডেমনিটি আইন করা গেছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী যে-ই ধরনের আইন ইচ্ছা করবে, তাঁর দলকে সেই ধরনের আইন-ই বানাতে হবে। তার মানে, এই সংসদ কোনো সংসদ নয়। বিচার বিভাগ কোনো বিচার বিভাগ নয়। প্রশাসন কোনো প্রশাসন নয়। নির্বাচন কোনো নির্বাচন নয়। এর সবগুলো হচ্ছে, যে একবার ক্ষমতায় যায়, তাঁর ইচ্ছাপূরণের একেকটা মাধ্যম। এইরকমের যে ক্ষমতা কাঠামো, এটাকে পরিবর্তন করা ছাড়া আপনি মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা, তার একটি আকাঙ্ক্ষাও পূরণ করতে পারবেন না। শুধু যদি গণতন্ত্রের কথাও যদি ধরি, তাহলে এইটাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সেজন্য, এই সংবিধানের পরিবর্তন, এখন, একধরনের একেবারেই অনিবার্য হয়ে গেছে। যেজন্য, যারাই এগুলোর জন্য দায়ী ছিল, তারাও এখন বলে যে, এটার আসলে মেরামত লাগবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি যেসব সমস্যার কথা বললেন, সেগুলোর বেশিরভাগই কিন্তু বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে এরকম এবসলিউট পাওয়ার বা বিশেষ একজনের বিশেষ ক্ষমতা বা একাধিপত্য একেবারে নিরঙ্কুশ করা হয়েছে। বা নির্বাচন পদ্ধতির প্র্যাক্টিক্যালি ইমপ্লিমেন্টেশনের জায়গা থেকে নানান সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আমাদের সংবিধানের যে মৌলিক ৪টি নীতি রয়েছে, এটা মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় এসেছে, সেগুলোর ব্যাপারে আপনার চিন্তাটা কীরকম?
হাসনাত কাইয়ুম : আমাদের সংবিধানের যে ৪ মূলনীতির কথা আপনি বললেন, সেগুলো আর্টিকেল এইট থেকে শুরু হয়েছে। অনুচ্ছেদ আট-এর ২-এর শেষের বাক্যটা এরকমঃ ‘এই মূলনীতিগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হবে, আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নির্দেশক হবে_এরকম অনেক অনেক ভালো ভালো কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শেষ লাইনটা হচ্ছে, তবে, এইসব মূলনীতি, আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।‘ তাইলে আপনি যে গণতন্ত্রের কথা বলছেন, জাতীয়তাবাদের কথা বলছেন, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলছেন, কিংবা সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন_এই ৪টিকে মূলনীতি বলছেন, যদিও এরমধ্যে আরো অনেকগুলো নীতিও আছে, কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই নীতিগুলোর কোনোটিই সরকার যদি না মানে আপনি তাকে মানাতে পারবেন না। সরকার যদি না মানে তাইলে তো সেগুলো আর মূলনীতি নয়, সেগুলোকে আপনি বলতে পারেন, অর্নামেন্ট; বা আলোচনার শুরুতে যেটা বলেছিলাম, গোলকধাঁধা! সাধারণভাবে পড়তে গেলে আপনার মনে হবে, এখানে অনেকগুলো ভালো জিনিসের সমাহার হয়েছে। মনে হবে, মুক্তিযুদ্ধের অনেক আকাঙ্ক্ষার এখানে স্বীকৃতি আছে। কিন্তু আপনি যখন এটা বাস্তবায়ন করতে যাবেন, গণতন্ত্রের কথা যেরকম বললাম, ধরেন সমাজতন্ত্রের কথা বলি। বাংলাদেশের সংবিধানের একটি মূলনীতি হলো সমাজতন্ত্র। এখন বাংলাদেশ ধরেন এইপথে চলতেছে যে, এইটা তো পুঁজিতন্ত্রও নয়, পুঁজিবাদেরও কতগুলো নিয়ম থাকে। এটা আসলে মাফিয়াতন্ত্র! ধরেন ব্যাংকের কথা, এখানে সাতটা-আটটা ব্যাংকের একজনমাত্র মালিক হয়ে বসতে পারে! এবং কেউ যখন এরকম মালিক হয়ে ব্যাংকে বসে তখন কী ঘটে? ধরেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রেগুলেটরি বডি, সেখানে ফিন্যান্স ডিভিশন আছে, সে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক রেগুলেটর বা নিয়ন্ত্রণ করবে! যে সংসদের কথা আমরা বলছি, সে সংসদে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়ে আইন বানানো হয়েছে, যে প্রাইভেট ব্যাংকগুলোতে আগে দুজন করে ডিরেক্টর হতে পারতো, এক পরিবারের, পরে এটা হয় ৪ জন, দুই বছর তিন বছর থাকতে পারতো, তার পরে এটা ৪ বছর, ৬ বছর, এখন তা ৯ বছর! তার মানে একেকটা ব্যাংকে, বাংলাদেশে ধরেন ৫০ থেকে ৫২টি প্রাইভেট ব্যাংক আছে। একটি ব্যাংক খোলার জন্য আপনার টাকা লাগে ২০ হাজার কোটি টাকা। এটা পেইড-আপ-ক্যাপিটাল লাগে। এখন ৫০টি ব্যাংক খুলতে লেগেছে এই ২০ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক যারা খুলেছে, তারা, বাংলাদেশের এই পঞ্চাশ ব্যাংক থেকে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি টাকা ঋণ নিয়েছে। আমি ২০ হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট করলাম, একটা গ্রুপ করে, আমি ঋণ নিলাম, ৪ লাখ কোটি টাকা। এরপর থেকে আমি সুদ মওকুফ করতে থাকলাম। ঋণ মওকুফ করতে থাকলাম। অবলোপনে যেতে থাকলাম। এগুলো সবই আসলে আইন করা হয়েছে! এটা এমন নয় যে, আইন অমান্য করে করা হয়েছে। তার মানে এই আইনগুলো বানানোর যে সংসদ, এই যে সমাজতন্ত্রের গল্প আপনি বললেন এবং এই যে আইন বানানোর ক্ষমতা আপনি হাতে রাখলেন, তাইলে মূলনীতি বলে আপনি যেটাকে এত গুরুত্ব দিয়ে আলাপ করেন, এই জিনিসগুলো আসলে আলাপের কোনো বিষয় না। বাংলাদেশের বাস্তবতার মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা যেভাবে ফাংশন করে, যেভাবে সে ক্ষমতা ব্যবহার করে, এই ক্ষমতার সাথে এই সমস্ত মূলনীতি আছে কী নেই, তা কোনো ম্যাটার করে না। পুরো মূলনীতি আপনি নেই করে দেন, তাতে এরচে আলাদা অন্য ভিন্ন কিছু আর কী হতে পারে? বাংলাদেশে ধরেন কোনো গণতন্ত্র নেই, কোনো সমাজতন্ত্র নেই, কোনো ধর্ম নিরপেক্ষতা নেই, তাইলে যা যা হবার, তার কোনটি আসলে হয় নি? তাইলে এগুলো থাকা না থাকার ওপরে বাংলাদেশের ক্ষমতা, এই যে দমনের ক্ষমতা, এটার সাথে ওইটার কোনো সম্পর্ক নেই। তারা বলেই রেখেছে, এটা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়। অতএব, মানুষকে যেটা বোঝানো হয় যে, এই সমস্ত মূলনীতির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আপনি আরো একশোটাও যদি লেখেন, এবং এইভাবে যদি লেখা থাকে, আরো এক হাজারটা লেখার পরেও এখানে, কোনো ধরনের মূলনীতির বাস্তবায়ন হবে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সক্রিয় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলোই সংস্কারের কথা বলছে, হয়তো তাঁদের মধ্যে পরিমানগত এবং গুণগতভাবে পার্থক্য আছে। এই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিন্তু আদর্শগত এবং অবস্থানগত পার্থক্যও অনেক। তাহলে তাঁদের মধ্যকার এই যে পার্থক্যগুলো, এগুলো সার্বিক সংস্কারের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কিনা বা দাঁড়াবে কি না সামনে?
হাসনাত কাইয়ুম : প্রতিবন্ধকতা আছে। কিন্তু আমি যেটা মনে করি সেটা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের ৫৩ বছরের যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, এগুলো এখন যেসব দল বাংলাদেশে আছে, তাঁদের সবারই প্রায় কাছাকাছি অভিজ্ঞতা। আপনি এর আগে আদর্শগত বা যেসব মূলনীতির কথা বললেন, যখন আপনি এরকম আদর্শভিত্তিক তর্ক করবেন, তখন বিভিন্নরকমের ভিন্নমত বা মতপার্থক্যের জায়গাটা তৈরি হবে। তো আপনি যদি বলেন, নির্বাচনটাকে ফেয়ার করার জন্য, একটা কেয়ার টেকার সিস্টেম লাগবে। আগে যেটা ছিল সেটাকে রেক্টিফাই করে আরো ভালো একটা কেয়ার টেকার সিস্টেম লাগবে। এটা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল কোনো আপত্তি করবে বলে মনে হয় না। যদি আপনি বলেন আদালত যেভাবে ধরেন, গত চোদ্দ-পনেরো বছর ধরে, যারাই বিচারের জন্য গেছে, তারাই জেনেছে। ধরেন, খালেদা জিয়া, তিনি আদালতে আপিল করেছেন, তার ধরেন শাস্তি আরো বাড়ানো হয়েছে। এই ধরনের বিচার বিভাগ তো কেউ চাইবে না। বিচারকরাও চায় না। ভুক্তভোগীরাও চায় না। রাজনীতিবিদরাও চায় না। তাইলে বিচার বিভাগের যদি সংস্কার করতে চান, টু সাম এক্সটেণ্ডেড আমার মনে হয়, সমস্ত রাজনৈতিক দল এটা এক্সেপ্ট করবে। আপনি যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতার কথা বলেন, যে এই লুটপাট চলবে না, এটা ভেতরে ভেতরে অনেকেই না করতে চাইতে পারে, কিন্তু (ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যেই যা করেছে) প্রকাশ্যে, তারা এসব বলে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে না। এরকম অবস্থা আর নেই। তার মানে আপনি চাইলে অর্থনৈ্তিক খাতে সংস্কার করতে পারেন। আপনার সংসদ, এটা তো আর সংসদ নেই। সংসদ সদস্যরা তো সাংবিধানিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর দাসানুদাস। ধরেন, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমার-আপনারও কথা বলার যে স্বাধীনতা রয়েছে, সেটাও তাঁদের নেই। তাইলে আপনি যদি সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা চান, এখন যারা রাজনীতি করে, তাদের অনেকেই তা চাওয়ার কথা। যারা সংসদ সদস্য হয়, তাদেরও চাওয়ার কথা। তার মানে, আপনি যদি সংসদের সংস্কার করতে চান, বিচার বিভাগের সংস্কার করতে চান, নির্বাচনের সংস্কার করতে চান,অর্থনীতির সংস্কার করতে চান, এগুলোতে সবাই কম-বেশি একমত হবেন। আমরা বাড়তি যেটা বলি, যেটা নিয়ে কেউ কেউ দ্বিমত করতে পারেন, সেটা হচ্ছে, স্থানীয় সরকারটাকে সরকার বানাতে হবে। বাংলাদেশের চলমান এককেন্দ্রীক ক্ষমতার একটি বড় সংকট হচ্ছে, স্থানীয় সরকারগুলো আসলে স্থানীয় সরকার নয়। এগুলো হচ্ছে কেন্দ্রীয় শাসনের স্থানীয় রূপ! এগুলোকে যদি স্থানীয় সরকার করতে পারেন, এবং এদের কাছে যদি আমরা আমাদের সেবাখাতগুলো ছেড়ে দিতে পারি; সংসদে যদি, শুধুমাত্র আইন বানানোর মধ্যে সংসদ সদস্যদের নিয়ে আসতে পারি, এবং সংসদ সদস্য হওয়ার মধ্যে যদি কোনো লাভ-ক্ষতি না থাকে, ব্যবসার জায়গাটা যদি ঠিক করা যায় যে, সে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডের মধ্যে যুক্ত হতে পারবে না, তাহলে রাষ্ট্রেরও সংস্কার হবে, রাজনীতিরও অনেকদূর পর্যন্ত সংস্কার হবে। এগুলোর কোনো কোনোটার সাথে কেউ কেউ আপত্তি করবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অনেক কিছুতেই অনেকের পক্ষেই একমত হওয়ার সুযোগ আছে যদি আমরা ৫৩ বছরের বাংলাদেশকে আমরা ফাংশনাল জায়গা থেকে দেখার চেষ্টা করি, যেগুলোতে আমরা ভুক্তভোগী হয়েছি। এখন, এই মুহূর্তে আমরা বলি যে, যেসব বিষয়ে যতদূর পর্যন্ত আমরা সবাই মিলে একমত হই, ততটুকু ততদূর পর্যন্ত এখন আমরা আগে করি। এইটুকু আমরা আগে করি। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, আগে আদর্শ থেকে ধরতে হবে। অনেকে মনে করেন, আমরা পুরোটা একবারে শেষ করবো। সেটা ধরেন, আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে ঠিক আছে। কিন্তু আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে তো আমরা সংবিধানই চাই না। আমি তো বলি, বাংলাদেশে সংবিধান লাগবে না। বাংলাদেশে এই সরকারগুলো কীভাবে চলবে, এটার এক ধরনের ব্যবস্থাপত্র লাগবে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ইন্টারন্যালি দরকার নেই। এক্সটারন্যাল সার্বভৌমত্ব থাকবে। ইন্টারন্যাল সার্বভৌমত্ব থাকবে নাগরিকের। রাষ্ট্রের কীসের সার্বভৌমত্ব? সে তর্ক তো ধরেন, আমরা করতে পারি। কিন্তু সেই তর্ক করে এই মুহূর্তে আমরা সবাইকে আনতে পারবো না। একটা হচ্ছে আমার চাওয়া। আমি চাই। আরেকটা হচ্ছে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমরা যে জায়গায় এসেছি, যে চাইলে করা যাবে। ধরেন, আমরা বাংলাদেশে গত ১০ বছর ধরে দাবি করে আসছি, রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে। আর এখন আমরা এমন জায়গায় এসেছি যে, আমরা সংস্কার করতে পারি। সেজন্য আমরা আগে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের পক্ষ থেকে এককভাবে যত দাবি করতাম, যত পরিবর্তনের কথা বলতাম, সরকার পরিবর্তনের পর, এখন আমরা এত দাবি করি না। এত কথা বলি না। আমরা বলি যে, ন্যূনতম যতটুকু করা সম্ভব আসুন আমরা এখন ততটুকু করি। করে, বাকিটা করার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাই। এবং এটা চাইলেই সম্ভব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : হ্যাঁ, সেটা করতে তো একটা প্রক্রিয়া বা একটা ফোরাম লাগবে। তো সংবিধান সংশোধন বলেন বা নতুন করে সংবিধান পুনর্গঠন বা পুনর্লিখন বলেন, সেটা যারা অনুমোদন করবে তা জাতীয় সংসদ। এই মুহূর্ত তো আর সেটা সম্ভব নয়। তাহলে সেই প্রক্রিয়াটা কী হতে পারে?
হাসনাত কাইয়ুম : আসলে বাংলাদেশে এটা আমাদের দুর্বলতা যে, এই আলাপটা আমরা খুব বেশি করতে পারি না। যখন আমরা এই আলাপগুলো করতাম, তখন আসলে মানুষ খুব বেশি মনোযোগ দিয়ে এগুলো শোনেনি। সংবিধান সংশোধন জাতীয় সংসদ করতে পারে, কিন্তু জাতীয় সংসদ সংবিধানের ব্যাপক কোনো সংস্কার করতে পারে না। পুনর্লিখন, পুনর্গঠন কিংবা নতুন করে করা, এসব জাতীয় সংসদ করতে পারে না। কেননা, জাতীয় সংসদ গঠিতই হয়, একটা সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে। যখন সংসদ নির্বাচিত হয়, তখন সে শপথ নেয় এই বলে যে, সে এই সংবিধানকে রক্ষা করবে। এবং এই সংবিধানের অধীনে সংবিধানকে রক্ষা করবে বলেই সে সংসদ গঠন করে। তাইলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় সরকার গঠনের জন্য। এবং সরকার পরিচালিত হয়, সংবিধানের মাধ্যমে। আর সংবিধান সংস্কারের জন্য কিংবা সংবিধান গঠনের জন্য যে নির্বাচন হয়, সেটাকে বলে, কন্সটিট্যুয়েন্ট এসেম্বলি নির্বাচন। আমাদের ৭০ সালে যে নির্বাচন হয়, ওটা ছিল কন্সটিট্যুয়েন্ট এসেম্বলি নির্বাচন। তখন এর বাংলা করা হয়েছিল গণপরিষদ নির্বাচন। পাকিস্তান আমলে ৪৬ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, ওই নির্বাচনের পরে ওদের কাছে, ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধান বানানোর জন্য। এটার যদি পরিবর্তন করতে হয়, সংবিধান সংস্কার করতে হয়, আমরা বলি যে, সংবিধান সংস্কার নির্বাচন কিংবা জাতীয় পরিষদ নির্বাচন বা গণপরিষদ নির্বাচন। এখন এরকম একটা লাগবে। তাইলে এটা কী হতে পারে? হতে পারে, এই সরকারের বিভিন্ন কমিশনের সাথে আমরা বিভিন্নজন বিভিন্ন প্রস্তাবনা দিচ্ছি। কথা হচ্ছে যে এটা সরকারকে দেবে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সংবিধান কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব পাওয়ার পর সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ করবে। আমরা বলেছি, এই আলাপটা আপনি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে যারা আছেন, তাঁদের সাথে করেন। বিভিন্ন শ্রেণিপেশা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল সেক্টরের সাথে কথা বলেন। তারপর দেখেন যে সেখানে কার কী ন্যূনতম দাবিদাওয়া চাওয়া-পাওয়া। আমি হয়তো একশোটা পরিবর্তন চাই, আপনি হয়তো দশটা চান। তাইলে দশটাই যদি বেজলাইন হয়, এটাই যদি ন্যূনতম হয়, তাহলে এইটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য সবাই মিলে একটা সংবিধান সংস্কার সভা নির্বাচনের জন্য একটা অর্ডিন্যান্স করেন। যেভাবে অর্ডিন্যান্স করে অন্য কাজগুলো করা হচ্ছে, এই যে কমিশনগুলো করা হচ্ছে, ওইরকম একটা নির্বাচন করা। তখন সংস্কার পরিষদের নির্বাচনের জন্য ৩ মাস বা ৬ মাস সময় নির্ধারণ করা। যে এরা এই সময়ের মধ্যে এটা বা ওটা তৈরি করে দিবে। আর ইতোমধ্যেই আমরা সবাই যেসব আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য একমত হলাম, সমঝোতা হলো, তখন সেগুলো আমরা লিখে দেবো। লিখে তাঁদের প্রস্তাবটা আপনি জাতিকে দিয়ে দেন। হ্যাঁ ভোট না ভোট একটা রেফারেণ্ডামের পর এটা যখন গৃহীত হয়ে যাবে, সেখানে আপনি নির্বাচন সংস্কারের ব্যাপারে যে প্রস্তাব এক্সেপ্ট করেছেন সংবিধানে, সে অনুযায়ী নির্বাচন দিয়ে দেবেন। তখন সেভাবেই নির্বাচন হবে। তখন আপনার প্রশ্ন আসতে পারে, এটা টেকসই হবে কিনা? অন্য কেউ এসে ফেলে দেবে কিনা? এভাবে যদি আমরা করি, কেউই কোনোভাবেই ফেলতে পারবে না। আদালতও এটা ফেলতে পারবে না। আরেকটা সংসদ এসেও এটাকে বাদ দিতে পারবে না। কারণ, তখন এটার মালিক হচ্ছে রাষ্ট্রের জনগণ। জনগণের সম্মতিতে হলে, জনগণই যখন এটা করবে, জনগণের জন্যই যখন এটা হবে, তখন আসলে আদালতের কিংবা সংসদের কোনো কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। আর এটা না করে, যেটা এখন বলা হচ্ছে মানুষকে, এটা ধোঁকা দেয়া হচ্ছে। মানুষকে বলা হচ্ছে, সংবিধান তো করবে আসলে সংসদ। সংসদ তো এই যে হাসিনা করেছিল, যেটা আমরা ফেলে দিচ্ছি। তার আগে বিএনপি করেছিল, সেটা আবার হাসিনা ফেলে দিয়েছে। এইভাবে পরিবর্তন করে করে, আমরা বার বার জীবন দিবো, তারপর আরেকটা দল ক্ষমতায় আসবে, সে এসে সংসদ দখল করবে আর তার মতো সব করবে; বা তাকে ফেলে আরেকটা দল আসবে সে আবার তার মতো করবে। সেটার জন্য বাংলাদেশের মানুষ এবার জীবন দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ এবার সংস্কারের জন্য জীবন দিয়েছে, সংশোধনের জন্য নয়। পার্লামেন্ট দিয়ে সংশোধন করার জন্য আসলে এবারের আন্দোলন হয়নি। এবারের আন্দোলন হয়েছে সংবিধানের সংস্কার করে, এখান থেকে স্বৈরতন্ত্রকে নির্মূল করার জন্য।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই পর্যায়ে এসে, আন্দোলনের শক্তিগুলোর মধ্যে দুই ধরনের মত আছে, কেউ বলছেন, দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদ গঠন করে সংস্কারটা নির্বাচিত সরকার করবেন। আবার আপনারা বলছেন যে, একটা গণপরিষদ করে সংবিধানের সার্বিক সংস্কারের পরে পরবর্তী ধাপে গিয়ে সংসদ গঠন করে দেশ পরিচালনা করবেন। এখানে সমঝোতার জায়গাটা কোথায়?
হাসনাত কাইয়ুম : সমঝোতার জায়গাটা আছে ৭০ সালের নির্বাচনে। ৭০ সালের নির্বাচনে কী ছিল? ৭০ সালের নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছিল, ন্যাশনাল এসেম্বলির মেম্বার হিসেবে তাঁদের দুটো দায়িত্ব ছিল। প্রথমে তারা ১৮০ দিন ছিল গণপরিষদের সদস্য। তাঁদের দায়িত্ব ছিল প্রথমে তাঁরা সংবিধান তৈরি করবে। সেটাকে প্রেসিডেন্ট অ্যাপ্রুভ করবে। প্রেসিডেন্টের অ্যাপ্রুভালের পর আসলে এই সরকার হবে, এই সরকার এই সংবিধানের আলোকে দেশ চালাবে। তার মানে আপনি যদি এখনো এটা করতে চান, তাহলেও ঠিক আছে, এখনো আমরা ৭০ সালের মতো নির্বাচন করতে পারি। নির্বাচন করে প্রথম ৬০ দিন কিংবা ৯০ দিন কিংবা ১২০ দিন বা ১৮০ দিন, যা-ই সময় লাগে, এরা এটা করতে পারে। কিন্তু এরা তখন কোনো সরকার নয়, এরা তখন সংবিধান সংস্কারের যে সমঝোতা হয়েছে, সেটুকু আসলে কাগজে-কলমে লিখে জনগণকে প্রেজেন্ট করবে। এবং একটা গণভোট করা। করে দিয়ে তারপর তারাই থাকুক। তাঁরা তারপরে ক্ষমতায় থাকুক, আমাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তাঁরা ক্ষমতায় গিয়ে তাঁদের ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করে দিয়ে বলবে যে, এটা আমাদের পরিবর্তন, না, এই নির্বাচন হবে না। বাংলাদেশে এই নির্বাচন আসলে করতে দেয়া যাবে না। এই নির্বাচন করলে, আমরা আমাদের যে সন্তানরা, জীবন দিয়েছে, তাঁদের সাথে বেঈমানি করা হবে। করতে পারে কেউ কেউ, কিন্তু গায়ের জোরে যদি কেউ করে, তাঁরা তখন ইতিহাসে জাতীয় বেঈমান হবে। এবং তাদেরও আবারও হাসিনার মতো পরিণাম পরিণতি হবে। তাদেরও হাসিনার মতো একটা পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে হবে। এটা করে তাঁরা পার পাবে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : না, আমরা কেউ-ই চাই না যে, আবারও কোনো অবস্থাতেই দেশ আগের জায়গায় ফিরে যাক। কিন্তু আপনি যে পুরো প্রক্রিয়াটার কথা বলছেন, সেটার জন্য সময় কত দিন দিতে রাজি আছেন?
হাসনাত কাইয়ুম : না, এটার জন্য খুব বেশি সময় তো দরকার নেই। এই প্রশ্নগুলো এই কারণে উঠছে যে, এই সরকার, যারা আমাদেরই সরকার, তাঁরা অসম্ভব অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। আমরা একদম তাঁদের ক্ষমতায় আসার পর পরই, ৮ তারিখে ক্ষমতায় এসেছে, আমরা হয়তো ১১ বা ১২ তারিখে, তাদেরকে লিখিত আকারে এই প্রস্তাবগুলো দিয়েছি যে তাঁদের করণীয় কী আছে। আমরা সেখানে বলেছি যে, আমাদের হিসাবে তখন থেকে ১৮ মাস লাগে, এর বেশি লাগে না। এবং ১৮ মাস নয়, ২৪ মাসও এখনো বাংলাদেশের মানুষ মানতে রাজি আছে, যদি তাঁরা, তাঁদের রোডম্যাপটা বলে যে, আমরা ২৪ মাসের মধ্যে এই কাজটা শেষ করবো। এটা বিএনপি মানবে, ছাত্ররা মানবে, অন্য রাজনৈতিক দল_ সবাই মানবে। কিন্তু যখন তাঁরা কথা বলে না, যখন তাঁরা রহস্য করে, তখন আসলে সন্দেহটা তৈরি হয়, এবং তখন অন্যরা এটা নিয়ে ক্লেইম করে। তাঁদের পরিস্কার করা দরকার যে, আসলে এই এই কাজগুলো আমাদের সামনে আছে, এই কাজগুলো করতে আমাদের সম্ভবত ১৮ মাস, ২০ মাস বা ২২ মাস লাগবে। কারণ এটা ধরে দিয়ে বলে দেয়া যায়, যে কতদিন লাগবে। আমি তো আমাদের ১৮ মাসের হিসাবের ব্রেকআপ দিতে পারি। ১৮ মাসের বেশি লাগার কোনো কারণ নেই। এবং ১৮ মাস নিয়ে কারো মধ্যে কোনোপ্রকার অধৈর্যতা তৈরি হবে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি কী সার্বিকভাবে আশাবাদী যে, এই প্রক্রিয়া শেষে, নতুন যে বাংলাদেশ হবে, সেটা পুরনো সেই দুঃসহ দুঃস্বপ্নের দিনগুলোতে আর ফিরে যাবে না?
হাসনাত কাইয়ুম : আমি মারাত্মকভাবে আশাবাদী মানুষ( হেসে)। আমি যখন রাষ্ট্র সংস্কারের গল্প বলতাম, বলতাম যে, একদিন বাংলাদেশে এটার বাইরে আর কোনো এজেণ্ডা থাকবে না। তখন আমি শুধু প্রশ্ন করবো, আপনি রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে না বিপক্ষে? আমাদের এরকম প্রশ্ন করতো না যে, আপনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে? অকারণ তর্কগুলো তুলতো। আমি বলি যে, কারণের তর্কগুলো উঠবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। এখন আমাদের ছেলেরা বলে, আপনি যখন এসব বলতেন, শুনে মনে হতো কিন্তু আমাদের বিশ্বাস হতো না। আমি আপনাকে বলি, ৫ আগস্টের পরের যে বাংলাদেশ, সে বাংলাদেশ এক নতুন বাংলাদেশ। আবু সাঈদের জীবন দানের পরের এই বাংলাদেশকে আপনি আগের বাংলাদেশে আর কখনোই ফিরাতে পারবেন না। যেমন ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনের আত্মাহুতির পর ব্রিটিশরা তাদের শাসনের বৈ্ধতা হারিয়েছিল। কতদিন লাগবে সেটা অন্য বিষয়। ব্রিটিশরা আর থাকতে পারবে না এটা নিশ্চিত ছিল। নূর হোসেনের জীবনদানের পরে, এরশাদের ক্ষমতায় থাকার আর কোনো আশা ছিলো না। বাকিটা হচ্ছে সময় কতদূর গেছে সেসব আমাদের স্টেপিং-এর জন্য। আবু সাঈদের জীবন দানের পরে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশকে কেউ পেছনে নিয়ে যাবে, এটা একেবারেই অসম্ভব। কোনো দিনই এটা সম্ভব নয়। আবু সাঈদের স্মৃতি যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা রাষ্ট্রের সংস্কার পর্যন্ত, কমপ্লিট করার পর অন্য জিনিস শুরু হবে, তার আগে নয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আমরাও চাইবো বাংলাদেশ যাতে আর পুরনো বা পেছনের দিকে ফিরে না যায়। বরং সামনের দিকে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবো। আর আমাদের হাহাকার আসবে না এই রাষ্ট্রের জন্য। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এতক্ষণ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
হাসনাত কাইয়ুম : আপনাকেও ধন্যবাদ।