রাশিয়ার ড্রোন ঠেকাতে ইউরোপের নতুন লড়াই

0
রাশিয়ার ড্রোন ঠেকাতে ইউরোপের নতুন লড়াই

লাটভিয়ার রাজধানীর উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি সাধারণ কারখানায় একটা ছোট দল একটি মহাদেশব্যাপী সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছে। তারা ভাবছে, কীভাবে ইউরোপ নিজেকে রাশিয়ার আক্রমণকারী ড্রোনের ঝাঁক থেকে রক্ষা করবে?

ইউক্রেন যুদ্ধে প্রায় প্রতি রাতেই ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রোন। এর পাশাপাশি ইউরোপের বিমানবন্দর এবং সংবেদনশীল স্থানগুলোর ওপর রহস্যময় ড্রোন অনুপ্রবেশের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। আর এতেই পরিষ্কার এখনও ড্রোন যুদ্ধের জন্য কিংবা এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত নয় ইউরোপ। 

এর ফলস্বরূপ, ইউরোপীয় নেতারা একটি ড্রোন প্রাচীর তৈরির পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছেন। এটি সেন্সর ও অস্ত্রের এমন একটি নেটওয়ার্ক যা অনুপ্রবেশকারী ড্রোনগুলোকে শনাক্ত, ট্র্যাক এবং নিরপেক্ষ করবে। রিগাতে, অরিজিন নামে একটি ছোট প্রযুক্তি কোম্পানি এই নতুন, উচ্চ-প্রযুক্তির যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রভাগে রয়েছে।

তাদের সমাধান হল ব্লেজ (Blaze) নামের একটি তিন ফুট লম্বা ইন্টারসেপ্টর ড্রোন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সিস্টেম পরিচালিত এই ড্রোনটিকে শত্রু লক্ষ্যবস্তুকে চিনতে এবং তার কাছাকাছি উড়তে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এটি তখন একজন মানব অপারেটরকে সতর্ক করে দেয়, যিনি ইন্টারসেপ্ট করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন এবং একটি বোতাম চাপেন। এতে ২৮-আউন্সের একটি ওয়ারহেড বিস্ফোরিত হয়, ড্রোনটি নিজে ধ্বংস হয়ে যায় এবং আশা করা যায় এর লক্ষ্যবস্তুটিও ধ্বংস হয়।

অরিজিন কোম্পানির সিইও অ্যাগ্রিস কিপুরস গত সপ্তাহে কারখানার বাইরে এক সাক্ষাৎকারে এনবিসি নিউজকে বলেন, আমরা এই সিস্টেমগুলোকে উড়াই না। এই সিস্টেমগুলো নিজেরাই ওড়ে। তিনি যোগ করেন, ব্লেজ তুলনামূলকভাবে সস্তা, নিচুতে-ওড়া, এবং বহু সংখ্যায় মোতায়েন করা হুমকির সমস্যাটির সমাধান করে।

এর আগে ক্রীড়াবিদদের অনুসরণ এবং চিত্রায়ণের জন্য ড্রোন তৈরি করতেন কিপুরস। তিনি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আক্রমণের পরে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে মনোযোগ দেওয়ার জন্য তার কাজ পরিবর্তন করেন।

ইউক্রেনীয় সরকারের অনুমান, রাশিয়া এখন প্রতিদিন ৩০০টিরও বেশি ড্রোন তৈরি করছে। যার প্রতিটির খরচ মাত্র কয়েক হাজার ডলার। এই ড্রোনগুলো দিয়ে কিয়েভ এবং অন্যান্য শহরগুলোতে প্রতি রাতে ব্যাপক বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। ইউক্রেনও যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়ার সুবিধা কমাতে তুলনামূলকভাবে সস্তা ড্রোন প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকেছে; গত বছর তারা ড্রোনের জন্য সামরিক বাহিনীর একটি পৃথক শাখা প্রতিষ্ঠা করে।

তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউরোপের উপর রহস্যময় ড্রোন দেখার ঘটনা মহাদেশের নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এই মাসের শুরুতে, বেলজিয়াম জানায় যে একটি সামরিক বিমান ঘাঁটির উপর পরপর তিন রাত ধরে ড্রোন দেখা গেছে। অন্যদিকে, চলতি বছরের শুরুতে জার্মানি, সুইডেন এবং ডেনমার্কের বেসামরিক বিমানবন্দরগুলোর ওপর ড্রোন দেখার খবর পাওয়া যাওয়ায় সেখানে সাময়িকভাবে ফ্লাইট বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

সম্ভবত সবচেয়ে গুরুতর সতর্কতা এসেছিল গত ৯ সেপ্টেম্বরের রাতে, যখন একাধিক রাশিয়ান ড্রোন পোল্যান্ডে প্রবেশ করে। ইউরোপীয় কর্মকর্তারা এটিকে একটি ইচ্ছাকৃত উস্কানি বলে বর্ণনা করেছিলেন। ন্যাটো জানায় যে তারা সাত ঘণ্টা ধরে চলা এক আকাশ যুদ্ধে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এবং ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে সাতটি রুশ ড্রোন গুলি করে নামায়। 

পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদেক সিকোরস্কি গত মাসে লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে আমাদের বাইরের সীমানা রক্ষার জন্য দ্রুত সেই ধাপগুলো তৈরি করতে হবে।

গুলি করে নামানো ড্রোনগুলোর বেশিরভাগই নিরস্ত্র ডিকয় (প্রতারক) হিসেবে পাওয়া যায়। এগুলো পলিস্টাইরিন দিয়ে তৈরি এবং রাশিয়ার জন্য খরচ অনুমান করা হয় মাত্র প্রায় ১০ হাজার ডলার। আর এই ড্রোন ভূপাতিত করতে ন্যাটো ৮০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এফ-৩৫ জেট ব্যবহার করে কয়েক লাখ ডলার মূল্যের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।

সিকোরস্কি স্বীকার করেন, এই হুমকির মোকাবিলা করার জন্য এটি সবচেয়ে লাভজনক উপায় নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে যে তথাকথিত ড্রোন প্রাচীরের জন্য সস্তা, আরও চটপটে প্রযুক্তি দরকার।

কিপুরস বলেন, লক্ষ্যবস্তুর চেয়ে অন্তত ১০ গুণ সস্তা এমন একটি লক্ষ্যের দিকে নির্ভুল-নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার কোনো মানে হয় না। তিনি যোগ করেন, আপনাকে বিষয়টি উল্টে দিতে হবে। আপনাকে অবশ্যই আপনার ইন্টারসেপ্ট করা লক্ষ্যবস্তুর চেয়ে ১০ গুণ সস্তা হতে হবে।

যদিও তার কোম্পানি প্রতিটি ইন্টারসেপ্টরের খরচ প্রকাশ করেনি, তবে তিনি আত্মবিশ্বাসী যে তারা রাশিয়ান ড্রোনের বিশাল সংখ্যা মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট সস্তায় সেগুলো তৈরি করতে পারে। যদি কোনো অপারেটর ইন্টারসেপশন বাতিল করে দেয় তবে ড্রোনটি আবার ঘাঁটিতে উড়ে আসবে এবং পুনরায় ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত থাকবে। এটা সম্ভাব্য একটি বড় খরচ বাঁচানোর উপায়।

অরিজিন হলো নর্ডিক এবং বাল্টিক দেশগুলোতে গড়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি। 

সুইডেন-ভিত্তিক নর্ডিক এয়ার ডিফেন্সের বিশেষ প্রকল্পের পরিচালক ডমিনিক সুরানো বলেন, তাদের লক্ষ্য হলো আমরা কীভাবে এই সুঁইচটি সুতোয় বাঁধতে পারি এবং কার্যকর কিছু তৈরি করার পাশাপাশি প্রতি-হত্যার খরচ কমাতে পারি।

তার সংস্থা ড্রোনে লক্ষ্য করার জন্য হালকা ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে, যা একটি গাড়িতে মাউন্ট করা যায় বা বিমানবন্দর, ইত্যাদির মতো বেসামরিক অবকাঠামো রক্ষাকারী একজন সৈন্য বা আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা হাতে-ধরা লঞ্চার থেকে নিক্ষেপ করতে পারে। তারা তাদের নিজস্ব স্বায়ত্তশাসিতভাবে নির্দেশিত ইন্টারসেপ্টর ড্রোনও পরীক্ষা করছে।

মার্কিন নাগরিক এবং এর আগে ড্রোন যুদ্ধ নিয়ে কাজ করা এবং আমেরিকান প্রতিরক্ষা সংস্থা অ্যান্ডুরিলের বিশেষ প্রকল্পে কাজ করা সুরানো বলেন, ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কাজ করা উত্তেজনাপূর্ণ, যেখানে বাজেট সীমিত এবং কোম্পানিগুলো ছোট। ২৫ জন কর্মী আছে এমন অফিসের সাথে ৫ হাজারের বেশি কর্মী আছে এমন কোম্পানির তফাৎ অনেক।

তবে অরিজিনের কিপুরসের মতে, উন্নয়নের দিক থেকে ছোট আকার ভালো হলেও উৎপাদনের মাত্রা বাড়ানো একটি চ্যালেঞ্জ। রিগার কারখানায় প্রযুক্তিবিদরা হাতে করে ড্রোনগুলো একত্রিত করেন।

তিনি বলেন, ইউরোপে মাত্রা বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ। ইউরোপকে মনস্থির করতে হবে এবং চ্যাম্পিয়নদের উপর বাজি ধরতে হবে, যাতে চ্যাম্পিয়নরা বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন করতে পারে। তিনি যোগ করেন, সরকার যদি ইন্টারসেপ্টরগুলিতে আগ্রাসীভাবে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে উৎপাদন দ্রুত বাড়ানো যেতে পারে।

লাটভিয়ার সামরিক ড্রোন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম মেজর মড্রিস কাইরিস জানান, লাটভিয়া ইতিমধ্যেই তাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করার জন্য ব্লেজ ড্রোন কেনা শুরু করেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here