যে কৌশলে অত্যাধুনিক নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে হামাস

0

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে নজিরবিহীন যুদ্ধ চলছে। গত শনিবার ভোরে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে অভিযান শুরু করে গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের যোদ্ধারা। এতদিন ইসরায়েলের বিপক্ষে শুধুমাত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়েছে ফিলিস্তিন। শনিবারই প্রথমবারের মতো আগে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের জুন মাসের যুদ্ধবিরতির পর প্রায় ২ বছর ধরে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা শেষে এই হামলা চালায় হামাস।

তবে অনতিবিলম্বে ইসরায়েলও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তারা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পাল্টা আক্রমণে দেশটি গাজায় মুহুর্মুহু বোমা বর্ষণ করছে। এরই মধ্যে ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৯০০ জনে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে আল জাজিরা।

রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আল জাজিরা দাবি করেছে, হামাসের হামলায় এরই মধ্যে ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা ১২০০ ছাড়িয়েছে। সেখানেও বহু সংখ্যক মানুষ আহত হয়েছে।

গাজা উপত্যকা থেকে শনিবার ভোরে যখন মুহুর্মুহু রকেট ইসরায়েলে আঘাত হানে, তখন হতভম্ব হয়ে যায় ইসরায়েল। আর এই হামলা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটিকে খুব সহজেই ফাঁকি দিয়ে। 

ইসরায়েল-গাজা সীমান্ত দেয়ালকে বলা হয় ‘স্মার্ট ফেন্স’,। বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায় অত্যাধুনিক বেড়া বা নিরাপত্তা বেষ্টনি। অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তিতে সজ্জিত এই দেয়াল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা লঙ্ঘনের কোনো চেষ্টা দেখলেই তা শনাক্ত করতে পারে।

‘আয়রন ওয়াল’

গাজা সীমান্তের ৪০ মাইল এলাকাজুড়ে ইসরায়েলের ‘স্মার্ট ফেন্স’ নির্মাণের কাজ শেষ হয় ২০২১ সালে। ২০ ফুট উঁচু বেড়ার নিচে আবার কংক্রিটও বসানো হয়েছে। যাতে সুড়ঙ্গ করে ঢোকা না যায়। 

২০১৪ সালের যুদ্ধে সুড়ঙ্গ তৈরি করে হামাসের হামলার পর ২০১৬ সালে এই প্রকল্পের ঘোষণা দেয় ইসরায়েল। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের মতে, বেড়া তৈরির জন্য প্রয়োজন হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টনেরও বেশি লোহা ও স্টিল। এছাড়া বসানো হয়েছে শত শত ক্যামেরা, রাডার এবং সেন্সর। গাজার কৃষকদের সীমান্ত পার্শ্ববর্তী স্থানে চলাচলেও সীমাবদ্ধতা আনা হয়। সম্ভাব্য হুমকির পূর্বাভাস পেতে এবং অনুপ্রবেশকারীদের গতি ধীর করতে বসানো হয় পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এবং বালিয়াড়ি।

২০২১ সালে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গানৎজ বলেন, হামাস এবং দক্ষিণ ইসরায়েলের মধ্যে ‘আয়রন ওয়াল’ এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা বসানো হয়েছে।

কিন্তু শনিবারের অতর্কিত, সমন্বিত এবং সুপরিকল্পিত হামলায় হামাস সেই দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বিভাগের তথ্যমেত, এক দুই জায়গায় নয়, সীমান্তের ২৯টি জায়গা দিয়ে প্রবেশ করেছে হামাস সদস্যরা। অথচ সীমান্তের প্রতি ৫০০ ফুট পরপরই পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আছে। কিন্তু দেখা গেছে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢোকার সময় হামাস সদস্যরা খুব কম প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন। 

মূলত পশ্চিম তীর নিয়ে ব্যস্ত ছিল ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তাই গাজা সীমান্তে কর্মী সংখ্যা ছিল কম। আর সেই সুযোগ দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছে হামাস।

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির সন্ত্রাস দমন কর্মসূচির পরিচালক ম্যাথিউ লেভিট বলেন, এই অত্যাধুনিক সীমান্ত প্রাচীরের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো নিরাপত্তা লঙ্ঘন হলেই সতর্ক সংকেত পাওয়া। কিন্তু আপনি যখন আগে থেকে সেই সতর্ক সংকেত দেখতে পান না, তখন এটি কেবলই একটি বেড়া। অনেক উঁচু বেড়া, তবে কেবলই বেড়া।

১. ড্রোন থেকে বিস্ফোরণ ফেলা

ড্রোন ব্যবহার করে সীমান্ত বেড়ার সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, যোগাযোগ অবকাঠামো এবং অস্ত্রাগারে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে হামাস।

২. রকেট ও সম্মুখ হামলার সমন্বয় 

ইসরায়েল জানিয়েছে, হামাস তিন হাজারের বেশি রকেট হামলা চালিয়েছে। কিছু রকেট তেল আবিব এবং জেরুজালেম পর্যন্ত পৌঁছেছে। আর হামাস সদস্যরা ফ্যান-চালিত হ্যাং গ্লাইডারে করে সীমান্ত পার হয়েছে।

৩. বেড়াজুড়ে বিস্ফোরণ 

সীমান্ত বেড়া ভাঙতে হামাস সদস্যরা বিস্ফোরক ব্যবহার করেছে। এরপর মোটরসাইকেল দিয়ে ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকেছে বাকিরা।

৪. বুলডোজার ব্যবহার 

বেড়ায় ভাঙনের পর বাকি কাজটুকো করেছে বুলডোজার। সীমানা প্রাচীর ভেঙে দেওয়ার পর বড় বড় সাঁজোয়া যান নিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ করে হামাস।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হামলার জন্য অন্তত এক সপ্তাহের পরিকল্পনা প্রয়োজন ছিল। 

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো মাইকেল ই. ও’ হ্যানলন বলেন, “মূল কাজ ছিল কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে সরঞ্জামগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে আসা। তারপর সেগুলোকে গোপন রাখা।”

তিনি বলেন, হ্যাং গ্লাইডার, মোটরসাইকেল কিংবা গাড়িগুলা পার্কিং এলাকায় কিংবা নির্মাণ কাজ চলছে এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু বেড়ার কাছাকাছি বুলডোজার লুকিয়ে রাখার সক্ষমতা অবাক করার মতো বিষয়। সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here