যেভাবে বিশেষ তরিকায় সংখ্যালঘু নিপীড়ন করছে ভারত

0
যেভাবে বিশেষ তরিকায় সংখ্যালঘু নিপীড়ন করছে ভারত

ভারতে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং কাশ্মীরিরা বর্তমানে ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্র-সমর্থিত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। তারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক গোঁড়ামির শিকার হচ্ছেন। ফলে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিও পুরোদস্তুর হুমকির পড়েছে। 

বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী বাগ্মিতা ভারতের ২২ কোটিরও বেশি মুসলিম জনসংখ্যার জন্য বড় উদ্বেগের কারণ। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রাজস্থানের বিকার শহরে প্রায় ২০০ জনের একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী গির্জার প্রার্থনাসভায় হামলা চালায় এবং লোহার রড দিয়ে উপাসনাকারীদের মারধর করে।

বর্তমানে ভারতে মুসলমান, খ্রিস্টান এবং কাশ্মীরিদের জন্য ভয় নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। মুসলিম মহল্লাগুলিতে উচ্ছেদ, পুলিশি অভিযান, আটক এবং হয়রানির ঘটনাও বাড়ছে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও চার্চে হামলা এবং প্রার্থনা সভার সময় হুমকি পাওয়ার কথা জানাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদের (হিন্দুত্ব) রাজনৈতিক একত্রীকরণ, গোঁড়ামির দৈনন্দিন স্বাভাবিকীকরণ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য প্রয়োগে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহারই চরমপন্থা, ঘৃণা জন্ম দিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র কাঠামো। গত দুই বছরে এই হার আরও বেড়েছে।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়া হেট ল্যাবের (আইএইচএল) তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে ভারতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের ঘটনা ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা গত বছরের জাতীয় নির্বাচনের সময় আরও বেশি ছিল। সংস্থাটি বলছে, এই উদ্বেগজনক বৃদ্ধি ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং বৃহত্তর হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আদর্শগত আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দু। মুসলমানরা বৃহত্তম সংখ্যালঘু, যাদের সংখ্যা ১৪ শতাংশ এবং খ্রিস্টানরা ২ শতাংশের সামান্য বেশি।

নয়াদিল্লি-ভিত্তিক খ্রিস্টান অধিকার পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান ফোরাম (ইউসিএফ) জানিয়েছে, ভারতে প্রতিদিন গড়ে দুইজনেরও বেশি খ্রিস্টান আক্রান্ত হচ্ছেন। গত এক দশকে এই হামলা বহুগুণে বেড়েছে। ২০২৪ সালে ৮৩৪টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল, যেখানে ২০১৪ সালে সংখ্যাটি ছিল মাত্র ১২৭। এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা প্রায়শই নীরব থাকেন, কারণ তারা প্রতিশোধের ভয় পান এবং মনে করেন অপরাধীরা রাজনৈতিক সুরক্ষা পাচ্ছে।

ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে (যার বেশিরভাগই বিজেপি শাসিত) ধর্মান্তর-বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। খ্রিস্টানরা দাবি করছেন, হিন্দু উগ্রপন্থি গোষ্ঠীগুলি তাদের আক্রমণ করার জন্য এই আইন ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, ২০১৯ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অমুসলিম সংখ্যালঘুদের দ্রুত নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বললেও মুসলিমদের বাদ দিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অজয় গুদাবর্থী ২০২৪ সালকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মনে করেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদ এখন কাঠামোগত রূপ নিয়েছে। বৈষম্যমূলক নীতি বা লক্ষ্যবস্তু করা পদক্ষেপগুলি আর কেবল সুস্পষ্ট নির্বাচনী বৈধতার ওপর নির্ভর করে না।

সাউথ এশিয়া জাস্টিস ক্যাম্পেইনের ২০২৫ সালের একটি পর্যালোচনা অনুসারে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু রাজ্য কর্তৃপক্ষ প্রধানত মুসলিম এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে, যাকে প্রায়শই বুলডোজার ন্যায়বিচার বলা হয়। শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে সারা ভারতে ৭৪শ’রও বেশি বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। যার ফলে ৪১ হাজারেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। এই ধ্বংসের শিকার হওয়াদের প্রায় ৩৭ শতাংশই মুসলিম।

অধিকার সংস্থাগুলির প্রতিবেদন আরও উল্লেখ করেছে, হিন্দু জনতা কর্তৃক মুসলিমদের লক্ষ্য করে নজরদারিমূলক সহিংসতা বেড়েছে। যেমন গবাদি পশুর পরিবহন বা গো-মাংস খাওয়ার সন্দেহে হামলা। এ ধরনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রায়শই চোখ বন্ধ করে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাষ্ট্রীয় নীতি যখন হিন্দুত্বের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, তখন ভারতের সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।

সূত্র: টিআরটি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here