৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অনেকে সুবিধাভোগী ভোল পাল্টানোর চেষ্টা করছেন। বিগত ১৭ বছর যারা ছিলেন আওয়ামী লীগের দোসর, তারা এখন বনে গেছেন অতি ‘বিপ্লবী’। ক্ষমতা লিপ্সু হাসিনার দোসর থেকে রাতারাতি ভোল পাল্টিয়ে ইউনূস সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করছেন। এরকমই একজন আহসান আকবর।
তিনি এক সময় ছিলেন আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী। ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও লিট ফেস্টের পরিচালক। টিউলিপের ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির সঙ্গেও ছিল সখ্যতা। নানার বাড়ি গোপালগঞ্জে হওয়ায় আওয়ামী ভাব ধরতেন। ওয়াসার বিতর্কিত এমডি তাকসিনও তার আত্মীয়। সেই আহসান আকবর হঠাৎ ভোল পাল্টে ৫ আগস্টের পর হয়েছেন বড় ‘বিপ্লবী’।
চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি আহসান আকবর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘সফট পাওয়ার, হার্ড অ্যাবিউজ: দ্য মিডিয়া মাফিয়া অব আওয়ামী লীগ’ শিরোনামে একটি সেমিনার আয়োজন করে। এই কথিত সেমিনারের পরই সাংবাদিক মহলে কৌতূহল জাগে আহসান আকবর সম্পর্কে। খোঁজ নিয়ে পাওয়া যায় চমকপ্রদ তথ্য। ওই সেমিনারে অংশ নেওয়া একাধিক সাংবাদিক জানিয়েছেন, সেমিনারের শিরোনাম দেখে মনে হয়, গোটা মিডিয়ার অপব্যবহার নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। কিন্তু ‘সেমিনার’টি ছিল আহসান আকবরের ব্যক্তিগত আক্রোশের জের ধরে কুৎসা রটনার একটি সংবাদ সম্মেলন মাত্র। ওই সেমিনারে অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক আশরাফ কায়সার।
সেই সংবাদ সম্মেলনে আহসান আকবরকে উপস্থিত সাংবাদিকরা আওয়ামী লীগ থেকে তার সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করেন। প্রশ্নের মুখে টিউলিপ সিদ্দিক ও রাদওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করেন আহসান আকবর। বলেন, তিনি টিউলিপের ক্যাম্পেইনে ছবি তুলেছিলেন, সেটা দেখিয়ে জেমকন গ্রুপের কর্ণধারদের কাবু করার উদ্দেশ্যে।
জানা গেছে, আহসান আকবর আসলে টিউলিপের বিভিন্ন নির্বাচনে নিয়মিত ও জোরালো ক্যাম্পেইন করেছিলেন। এমনকি টিউলিপের স্বামী ক্রিসকে বাংলা শেখানোর কাজও করেছেন তিনি।
এছাড়া আহসান আকবর ঢাকা লিট ফেস্টে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে অতিথি হিসেবে নিয়ে যান। সেখানে সিআরআই থেকে প্রকাশিত শেখ মুজিবুর রহমানের ছোটবেলার জীবনী নিয়ে একাধিকবার বিশেষ আলোচনা ও স্টল রাখা হয়।
সূত্র থেকে প্রাপ্ত নথিতে দেখা যায়, ঢাকা লিট ফেস্ট আয়োজন করতো ‘যাত্রিক’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সাদাফ সাযও লিট ফেস্টের একজন পরিচালক। লিট ফেস্টের অপর পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ। কাজী আনিস আহমেদের পরিবার সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠান লিট ফেস্টে ব্যাপক স্পন্সর করে। কিন্তু আহসান আকবর ও সাদাফ সাযের ভূমিকা ছিল ভিন্ন– টাকা তোলা।
আহসান আকবর ও সাদাফ সায যৌথভাবে লিট ফেস্ট পরিচালনার নাম করে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আওয়ামী লীগ সরকার থেকে কোটি কোটি টাকা স্পন্সর হিসেবে আদায় করতেন। তবে লিট ফেস্টের নামে তোলা টাকা, এমনকি সরকারি অনুদানও যেত যাত্রিক-এর অ্যাকাউন্টে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লিট ফেস্ট ঘনিষ্ট সূত্র জানায়, এত টাকা তোলার পরও প্রতি বছর ভেন্ডরদের পেমেন্ট বাকি থেকে যেত। এরকম কেন হয়েছে বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে। যেহেতু এখানে সরকারের তথা জনগণের টাকাও অনুদান আকারে ছিল। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, আহসান আকবর ও সাদাফ সায দু’জনেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের অনুবাদ সংক্রান্ত সাব-কমিটির কো-অপ্ট সদস্য ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা লিট ফেস্টে বিদেশ থেকে যেসব অতিথি আনা হতো, তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে আনা হতো। যাতে সরকারের কোষাগারে কর দিতে না হয়। কর ফাঁকি ছাড়াও অতিথিদের উচ্চ অংকের সম্মানীর খাত দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন আহসান আকবর বলে অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লিট ফেস্টের একজন প্রাক্তন কর্মী। এই সূত্রমতে সেই টাকা আহসান আকবর লন্ডনেও পাচার করেছেন।
জানা গেছে, আহসান আকবর দীর্ঘদিন লন্ডনের টিটুলিয়া টি ইউকে’র সিইও হিসেবে কাজ করতেন। আহসান আকবরের অদক্ষতা ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ নয়ছয় করার কারণে বছর দুয়েক আগে প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এই সময় থেকে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে জেমকন গ্রুপের কর্ণধারদের কাছে নানা উছিলায় টাকা চাইতে শুরু করেন আহসান আকবর। এক পর্যায়ে ৭ লাখ ৩০ হাজার পাউন্ড ‘ক্ষতিপূরণ’ দাবি করে বসেন। লিখিত সেই দাবির ই-মেইল এই প্রতিবেদক দেখেছেন।
জেমকনের কর্ণধাররা এরকম উদ্ভট দাবিতে সাড়া না দিলে আহসান আকবর তাদের নানা প্রকার হুমকি দিতে শুরু করেন। সেই হুমকি সম্বলিত ই-মেইলও এই প্রতিবেদক দেখেছেন। এক পর্যায়ে জেমকনের মালিকরা বাধ্য হয়ে যুক্তরাজ্যে আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালত জরিমানাসহ আহসান আকবরের বিরুদ্ধে রায় দেন। এরপর থেকেই আহসান আকবর বাংলাদেশে জেমকনের মালিকদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার ক্যাম্পেইনে নামেন।
নিজেকে কবি ও লেখক হিসেবে দাবি করলেও আহসান আকবরের একটি মাত্র কবিতার বই বাজারে রয়েছে। তার সেই একমাত্র কবিতার বইটিও জেমকন গ্রুপের পরিচালক কাজী আনিস আহমেদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল লাইটস থেকেই ছাপা, তাও ২০১৩ সালে।
আহসান আকবরের সাম্প্রতিক ‘সেমিনার’ নিয়ে আরও সন্দেহ জাগে- কারণ সে আওয়ামী লীগের সাফাই গাওয়ারও চেষ্টা করে। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সবাই খারাপ নয়। উপরের লোকজন খারাপ হলেও মাঠের অনেকেই ভালো। তার এই বক্তব্যে অনেকে মনে করছেন, তিনি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বিপ্লবী সেজে আওয়ামী লীগের বিষয়ে সফট ধারণা তৈরির জন্য মাঠে নেমেছেন। এ ধরনের ব্যক্তিগত ও মিশ্র উদ্দেশ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আশরাফ কায়সারের মতো ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণ- উপস্থিত অনেক সাংবাদিককেও বিস্মিত করে।