বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। গত ডিসেম্বরে ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়িয়েছে ৭.২৮ শতাংশ, যা এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম। তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভয়াবহ সংকট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, টাকার অবমূল্যায়ন ও বিনিয়োগ মন্দাসহ নানা কারণে দেশের বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা নেমেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বেনামি-জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কমে এসেছে।
এর পাশাপাশি দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ও পর্ষদে পরিবর্তন হয়েছে এমন ১১টি ব্যাংকের নতুন ঋণ প্রদান বন্ধ থাকায় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এই ব্যাংকগুলো অবশ্য আমানতকারীদের টাকার চাহিদা মেটাতেই এখন হিমশিম খাচ্ছে। এ জন্য কমেছে প্রবৃদ্ধি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, দ্রুতই বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হবে এবং এই সমস্যার সমাধান হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশ হয়েছিল, দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.৫৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে অর্জিত প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে নিচে রয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৯.৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।
তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৫০ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ছিল চার লাখ ১৫ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। অন্যান্য সরকারি খাতের ঋণ ছিল ৫০ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের একই সময়ে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা বা ৭.২৮ শতাংশ।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে আসায় অনেক ব্যাংক সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। এতে ঋণের চেয়ে বেশি মুনাফা মিলছে। কারণ ঋণ দিলে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি থাকে আর বিল ও বন্ডে মুনাফা নিশ্চিত হয়। আর সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি কমে, আবার ব্যাংকে পরিচালন ব্যয়ও সংকুচিত হয়।
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংকগুলোর তারল্যের সংকটের কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের পরিবেশ ছিল না। এ জন্য এই খাতের বিনিয়োগ কমেছে। তবে সরকারের স্থিতিশীলতায় এটি আবার বাড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই আগামী মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে। নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, ‘জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করছেন কম। বিনিয়োগের পরিবেশ তখনই তৈরি হয় যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। আমাদের হিসাবে জুলাই মাসের এক সপ্তাহেই পোশাকশিল্পে ক্ষতি হয় এক বিলিয়নের ওপর। আর ব্যাংক বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানির ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব তো পড়েছেই। ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারে ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। এ রকম ক্ষতি হওয়ার পর ব্যবসায়ীরা বেশি বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন না। দেশের অর্থনীতির ওপর টানা দুই মাস ধকল যাওয়ার পর সবাই পরিস্থিতি বিবেচনার মধ্যে আনে। তাই ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার দরকার পড়েনি, চাহিদা কমে গেছে।’
জানতে চাইলে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এখন অনেকেই বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। ফলে ঋণের চাহিদা কম। এতে কর্মসংস্থান ও কর আদায় দুটোই বাধাগ্রস্ত হবে, যা অর্থনীতি ও দেশের জন্য ভালো নয়। সে জন্য বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতিতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
গত বছরের প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে মোটাদাগে অর্থনীতিতে তিনটি সমস্যা ছিল। সেগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা ও আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়।