বেইজিংয়ে ইউনূসকে লাল গালিচা সংবর্ধনা

0

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বেইজিংয়ে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েছে চীন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, গতকাল রাত ১০টা ২০ মিনিটে ড. ইউনূস হাইয়ান প্রদেশ থেকে দেশটির রাজধানী বেইজিং পৌঁছান। এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে নামতেই তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায় চীন। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান দেশটির ভাইস মিনিস্টার সান উইডং। বিমান থেকে নামার পর ড. ইউনূস তাঁর সম্মানার্থে সম্মানজনক লাল গালিচা ধরে হেঁটে যান। এ সময় দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ‘গার্ড অব অনার’ দেন এবং প্রধান উপদেষ্টা গার্ড পরিদর্শন করেন। আজ সকালে বেইজিংয়ের ‘গ্রেট হল অব দ্য পিপল’-এ দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে ড. ইউনূসের। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে এটিই ড. ইউনূসের প্রথম চীন সফর। এর আগে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) সম্মেলনে যোগ দিতে চার দিনের সফরে গত ২৬ মার্চ চীনের হাইয়ান প্রদেশে পৌঁছান তিনি। পরদিন ২৭ মার্চ সেখানে ব্যস্ত সময় পার করেন ড. ইউনূস।

এর আগে বিএফএ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতায় এশীয় দেশগুলোকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও যৌথ সমৃদ্ধির জন্য একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরির আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুর্বল সংযুক্তি বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত করছে মন্তব্য করে তিনি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে এ অঞ্চলের দেশগুলো একসঙ্গে কাজ করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।

গতকাল বিএফএ সম্মেলনের ফাঁকে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার চেয়ারম্যান বান কি-মুন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর মহাপরিচালক কু ডংগিউও, চীনের স্টেট কাউন্সিলের নির্বাহী উপ-প্রধানমন্ত্রী ডিং জুয়েশিয়াং, রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি ওভারচুক, চীনের এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান চেন হুয়াইউ ও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়নার সাবেক উপ-গভর্নর উ শিয়াওলিং-এর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় তিনি বেইজিংয়ের উদ্দেশে হাইনান ত্যাগ করেন।

এ বছর বিএফএ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হলো- ‘এশিয়া ইন দ্য চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড : টুওয়ার্ডস আ শেয়ারড ফিউচার’। সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, এশীয় দেশগুলোর ভাগ্য পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এশিয়াকে অবশ্যই একটি টেকসই অর্থায়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়াতে হবে। আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে ভোগ সীমিত রাখতে হবে। সমৃদ্ধির জন্য আমাদের একটি সুস্পষ্ট ও অভিন্ন রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনে এশীয় নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ গত সাত বছর ধরে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যারা মিয়ানমারের নাগরিক। এ জন্য আমরা বিপুল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ব্যয় বহন করে চলেছি। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। এশিয়ার নেতাদের একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। গাজায় গণহত্যার সমালোচনা করে তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব বহুমুখী সংকটে ভুগছে, যেখানে যুদ্ধ ও সংঘাত মানবাধিকারের ক্ষতি এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে। বিশ্বব্যাপী নিন্দা চলমান থাকলেও গাজায় গণহত্যা এখনো চলছে। ফিলিস্তিন সংকট শুধু আরব বা মুসলিমদের বিষয় নয়, এটি একটি মানবিক সমস্যা। তিনি বলেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জলবায়ু দুর্যোগজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল্য। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে সম্পদ ব্যবহার করে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ সীমিত করে দিচ্ছে। আমাদের ঋণ-সৃষ্টিকারী নয়, অনুদান-ভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়ন প্রয়োজন। দুর্নীতি ও আর্থিক অপচয় রোধের আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থপ্রবাহের শিকার। এই ধরনের দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতি বছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যা তারা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে যে অর্থ পায় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্পদ পুনরুদ্ধার ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য একটি বহুপক্ষীয় মধ্যস্থতা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সম্মেলনে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার মহাসচিব ঝাং জুন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বোয়াও ফোরামের চেয়ারম্যান বান কি-মুন এবং চীনের স্টেট কাউন্সিলের নির্বাহী উপ-প্রধানমন্ত্রী ডিং জুয়েশিয়াং বক্তব্য রাখেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ড. ইউনসূকে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান চেন হুয়াইউ আশ্বস্ত করে বলেন, তাঁর ব্যাংক বাংলাদেশে চীনা উৎপাদন কেন্দ্র স্থানান্তরে সহায়তা করবে, যাতে অন্যান্য দেশে রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক কু ডংইউর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে চীনে বৃহৎ পরিসরে ফল ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে এফএওর সহযোগিতা চান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশকে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে ফাওর মহাপরিচালক বলেন, তার সংস্থা চীনে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানির লক্ষ্যে একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করবে এবং দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করবে।

বেইজিংয়ে আজ ইউনূস-শি বৈঠক : চীন সফররত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে আজ গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকে যোগদানের লক্ষ্যে চীনের হাইনানে অনুষ্ঠিত বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান শেষে গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় বেইজিংয়ের উদ্দেশে যাত্রা করেন ড. ইউনূস।

ড. ইউনূসের চার দিনের চীন সফরে অর্থনৈতিক বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে বলে জানিয়েছেন তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এ সময় কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। সফরের অংশ হিসেবে ড. ইউনূস ২৯ মার্চ সকালে দেশটির বিশ্বখ্যাত পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়ার কথা রয়েছে। একই দিন রাতে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।

এর আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, ড. ইউনূসের এ সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশকে একটা বৈশ্বিক ম্যানুফেকচারিং হাব (উৎপাদন কেন্দ্র) হিসেবে গড়ে তুলতে চায় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকার। সে লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার সফরে চীনের কারখানাগুলো কীভাবে বাংলাদেশে স্থানান্তর করা যায়, সে বিষয়টি আলোচনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here