‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের যুবককে ওড়িশায় পিটিয়ে হত্যা

0
‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের যুবককে ওড়িশায় পিটিয়ে হত্যা

ভারতের ওড়িশা রাজ্যে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের এক মুসলমান যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বুধবার রাতে এ ঘটনা ঘটে।

নিহত ওই যুবক সেখানে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। একই ঘটনায় তার দুই সহকর্মীও পিটুনির শিকার হন। বর্তমানে তারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

পুলিশ জানিয়েছে, ওই ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

স্থানীয় সময় বুধবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ এই ঘটনা ঘটে ওড়িশার সম্বলপুর জেলায়। সম্বলপুরের মহকুমা পুলিশ অফিসার, এসডিপিও জানিয়েছেন, আইন্থাপল্লী থানার অন্তর্গত দানিপালি এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।

নিহত ওই যুবক ১৯ বছর বয়সী জুয়েল রানা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের সুতি অঞ্চলের বাসিন্দা। মাত্র পাঁচদিন আগে তিনি বাড়ি থেকে কাজ করতে ওড়িশায় যান।

তার দুই সহকর্মী, যারা ঘটনার সময় খুব কাছেই ছিলেন, তারা বলেছেন- দুষ্কৃতকারীরা বুধবার মারধর করে। তারা প্রথমে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে এবং পরিচয়পত্র দেখতে চায়।

পরিযায়ী শ্রমিকদের একটি সংগঠন বলছে, কেন্দ্রীয় সরকার ‘বাংলাদেশি’ এবং ‘রোহিঙ্গা’ ধরার যে বিশেষ প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাভাষী মুসলমানরা এভাবে একের পর এক বাংলাদেশি সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন।

কী ঘটেছিল বুধবার রাতে?

“জুয়েল আর বাকি দু’জন ঘরে রান্নাবান্না করে খেয়ে বাইরে বেরিয়েছিল বিড়ি খেতে। আমাদের ঘরের একেবারেই পাশে ওরা থাকত। একদল স্থানীয় প্রথমে এসে ওদের কাছ থেকে বিড়ি চায়,” ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন পরিযায়ী নির্মাণ শ্রমিক পল্টু শেখ।

“তখন রাত সাড়ে আটটা হবে। ওই দলটা বিড়ি চাওয়ার পরই সন্দেহ করে যে জুয়েলরা তিনজন বাংলাদেশি কি না, আধার কার্ড দেখতে চায়। একজন আধার কার্ড আনতে ঘরে গেছে, এরমধ্যেই মারধর শুরু করে দেয় ওই স্থানীয় লোকেরা,” বলেন পল্টু শেখ।

তিনি বলেন, এর আগেও বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে তাদের হুমকি দিয়েছে স্থানীয় লোকেরা। কিন্তু এতদিন কেউ মারধর করেনি, যে ঘটনা ঘটল বুধবার রাতে।

তার কথায়, “ওদের হাত থেকে একজন পালিয়ে এসে আমাদের ঘরে খবর দেয় যে আমায় বাঁচাও, মেরে ফেলছে। আমরা সবাই তখন বেরিয়ে আসি।”

আরেকজন নির্মাণ শ্রমিক সাদ্দাম হুসেন বলেন, “চিৎকার শুনে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি ওই লোকগুলো অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পালিয়ে গেল। এরপর আমরা সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। জুয়েল মারা গেছে। গ্রামে খবর দেওয়া হয়েছে।”

মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি এক নম্বর ব্লকের অধীন চক বাহাদুরপুর গ্রামে জুয়েল রানার বাড়ি।

তার এক চাচা রিয়াকুল শেখ বলেন, তিনি প্রত্যক্ষদর্শী অন্যান্য শ্রমিকদের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন- ওরা তিনজন খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিড়ি খাওয়ার সময় এই ঘটনা ঘটে। চার-পাঁচজন গুন্ডা এসেছিল। তারা জুয়েলদের তিনজনকে বলে যে তোমরা বাংলাদেশি, ভারতে কেন থাকবে। জয় শ্রীরাম স্লোগান দিতে বলেছিল। মারধর করার সময় মোবাইল কেড়ে নেয়।”

যা বলছে ওড়িশা পুলিশ

যে এলাকায় জুয়েল রানাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেই আইন্থাপল্লী থানা এলাকাটি সম্বলপুর মহকুমার অধীন।

মহকুমা পুলিশ অফিসার তোফান বাগ বিবিসির সংবাদদাতা সুব্রত পতিকে ঘটনাক্রমের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শী জুয়েল রানার সহকর্মীদের বয়ান প্রায় মিলে গেছে।

তোফান বাগ বলেছেন, তিনজন শ্রমিক বিড়ি খাচ্ছিলেন। সেই সময়ে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা সেখানে গিয়ে আধার কার্ড দেখতে চায়। তারপরই তিনজনকে মারধর করে। একজন ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন।

তার মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে এবং পরিবারকে খবর দেওয়া হয়েছে বলে জানান তোফান বাগ।

এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছয়জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং তদন্ত এখনও চলছে।

দু’জন আহতকে সম্বলপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং তাদের শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল বলে বিবিসির সংবাদদাতা জানিয়েছেন।

কেন একের পর এক গণপিটুনিতে হত্যা?

ডিসেম্বর মাসেই ভারতের তিনটি রাজ্যে গণপিটুনিতে মৃত্যুর তিনটি ঘটনা সামনে এসেছে।

এর মধ্যে বিহারে একজন মুসলমান ফেরিওয়ালা তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে গণপিটুনির শিকার হয়ে হাসপাতালে মারা যান। তিনি পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে ছত্তিশগড় থেকে কেরালায় কাজের খোঁজে গিয়েছিলেন।

কেরালায় একজন দলিত শ্রেণির হিন্দুকে বাংলাদেশি সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়।

তৃতীয় ঘটনাটি বুধবার রাতে, ওড়িশা রাজ্যে ঘটল। জুয়েল রানাও পরিযায়ী শ্রমিক ছিলেন। মুর্শিদাবাদ থেকে কাজে গিয়েছিলেন ওড়িশায়।

ওড়িশা রাজ্যে এ মাসেই বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা এক মুসলমান যুবক। তাকে মারধর ও ‘জয় শ্রীরাম’ বলার জন্য শারীরিক নির্যাতন করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী এই রাজ্যটিতে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো ঘটনা সামনে এসেছে, যেখানে বাংলাভাষী শ্রমিক, ফেরিওয়ালাদের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে গণপিটুনি বা হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে।

পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক বলেন, “এই গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা যেন থামছেই না। প্রায় সবক্ষেত্রেই নিশানা করা হচ্ছে বাংলাভাষী মুসলমানদের, পরিযায়ী শ্রমিকদের। এরমধ্যে আবার ওড়িশায় সম্প্রতি বাংলাভাষী মুসলমানদের ওপর হেনস্থা, মারধরের ঘটনা প্রচুর হচ্ছে।”

“কেন্দ্রীয় সরকার সাত-আট মাস আগে যে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা খুঁজে বের করে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করার নির্দেশ দিয়েছে, তার ফলেই এধরনের ঘটনা খুব বেড়ে গেছে। ওই নির্দেশ ছিল সব রাজ্যের পুলিশের প্রতি, কিন্তু সেই সুযোগটা নিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এই কাজে নেমে পড়েছে। আর ওড়িশায় বিজেপি-ই তো এখন ক্ষমতায়। তাই বোঝাই যাচ্ছে যে, কাদের প্রচ্ছন্ন মদতে এই গণপিটুনি আর হেনস্থার ঘটনা ঘটছে,” বলেন ফারুক।

তার দাবি, রাজ্য প্রশাসন ওড়িশা সরকারের সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করুক।

নিহত জুয়েল রানার বাড়ি যে অঞ্চলে, তার পাশের বিধানসভা কেন্দ্রে বিধায়ক ও রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতরের প্রতিমন্ত্রী আখতারুজ্জামান বলেন, “রাজ্যের মুখ্যসচিব তার পর্যায়ে কথা বলেছেন, আমাদের সরকার বারবার কেন্দ্রীয় সরকারকেও জানিয়েছে বিষয়টা। কিন্তু বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার বা যেসব রাজ্যে বিজেপি সরকার আছে, তাদের মূল অ্যাজেন্ডাই তো বাঙালি বিরোধী, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান বিরোধী।” সূত্র: বিবিসি বাংলা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here