বগুড়ায় গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে যমুনার। ইতিহাস থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে সুখদহ নদী। জেলার প্রধান প্রধান নদীগুলো দিন দিন মরে যেতে বসেছে। পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, দূষণ, পলি পড়ে ভরাট, দীর্ঘদিন খনন না হওয়া, বাঁধ দিয়ে চাষাবাদ করা, জনবসতির ড্রেনের পানি নদীতে ফেলা, নদীর দুই পাড় ইচ্ছেমত দখলের কারণে নদীগুলো মরে যাচ্ছে। যমুনা, বাঙ্গালী ও সুখদহসহ অন্যান্য উপনদীগুলো ধীরে ধীরে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, বর্ষাকালে নদী ভরাট থাকায় গতিপথ তেমন বোঝা না গেলেও শুকনা মৌসুমে মূল প্রবাহ থাকছে না যমুনায়। সারিয়াকান্দির কালিতলা গ্রোয়েন বাঁধ থেকে পূর্ব দিকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে মূল প্রবাহ সরে যাওয়ায় নতুন নতুন চর জাগতে শুরু করেছে নদীটিতে। শুকনো মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় যমুনা চরের মানুষ পায়ে হেঁটে পারাপার হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও হাঁটু পানি দিয়ে পারাপার হচ্ছে এলাকাবাসী। কেউ কেউ যমুনাতে জেগে ওঠা চরে বিভিন্ন ফসল ফলাচ্ছে। চাষাবাদ হচ্ছে মরিচ, মাশকলাই, ভূট্টা, কাউন, পেঁয়াজ ও বোরো ধান।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে যমুনা নদীর অবস্থান ছিল বাম তীর ঘেঁষে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে নদী ভাঙতে ভাঙতে ডান তীর ঘেঁষে অবস্থান নেয়। ডান তীরে নদী শাসনের কাজ হওয়ায় বর্তমানে নদী আবারও বাম তীর ঘেঁষে অবস্থান করছে। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গত আড়াই দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার বিভিন্ন অংশে যমুনা নদীর ডান তীরে প্রায় ৫৬০ মিটার ভেঙেছে। ২০১০ সালের পর থেকে সরকারিভাবে নদী শাসনের কাজ হওয়ায় এ এলাকা বন্যায় বড় আকারে আর ভাঙেনি।
এদিকে বর্ষার ভরা যৌবনে দুই কূল উপচিয়ে দাপিয়ে চলা যমুনা নদী ফাল্গুনে শুকিয়ে যাওয়ায় হেঁটেই পার হচ্ছে স্থানীয়রা। নিয়মিত ড্রেজিং না করায় নাব্যতা সংকটে নদীটি। উজান থেকে আসা পলিতে নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোটো বড় অসংখ্য চর। ফলে নৌকা আটকে যাচ্ছে ডুবোচরে, চলাচল কমে বন্ধ হয়েছে বেশ কয়েকটি নৌরুট। এতে বিপাকে নদীপথে যাতায়াতকারী হাজারো যাত্রী ও চরাঞ্চলের মানুষেরা। সারিয়াকান্দি ও আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার মানুষ যমুনা নদীর কালীতলা ঘাট থেকে শ্যালো মেশিন চালিত নৌকায় জামালপুর ও খেয়া নৌকায় বাগবের, গজারিয়া, চরবাটিয়া, শালুখা কুড়িপাড়া, পাখিমারাসহ বিভিন্ন চরে যাতায়াত করেন। কিন্তু যমুনা নদীতে নাব্যতা সংকট দেখা দেওয়ায় ঘাটের দক্ষিণে চর জেগে ওঠেছে। নদীর বুকেই হচ্ছে চাষাবাদ। নদীর মাঝখান এখন সরু খালের মতো। কোথাও হাঁটুপানি, হেঁটেই পার হওয়া যায় এপাড় থেকে ওপাড়। নদীর তীরে পড়ে আছে নৌকা। আবার কিছু নৌকা চলাচল করলেও তা গন্তব্যে যেতে দ্বিগুণ সময় লাগছে। এতে একদিকে যেমন সময় অপচয় হচ্ছে, তেমনি বাড়তি ভাড়া দিয়ে তাদের চলাচল করতে হচ্ছে। কৃষিপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবহণে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে।
সারিয়াকান্দি পৌর এলাকার বাসিন্দা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী আপেল মাহমুদ লাভলু জানান, যমুনা নদীর নাব্য সংকটের কারণে নদীপথে নৌকা নিয়ে যেতে অনেক সময় লাগছে। বর্ষাকালে নদী ভরাট থাকায় গতিপথ তেমন বোঝা না গেলেও শুকনা মৌসুমে নদীর মূল প্রবাহ থাকছে সারিয়াকান্দির কালিতলা গ্রোয়েন বাঁধ থেকে পূর্বে দিকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। মূল প্রবাহ সরে যাওয়ায় নতুন নতুন চর জাগতে শুরু করেছে। বর্ষাকালে পানি দেখা গেলেও সারা বছর আর পানি থাকে না। এক সময় জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলায় নদীর পানি কৃষি কাজে লাগলেও এখন সেই নদীতে চর জেগেছে।
এছাড়া ইতিহাস থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে সুখদহ নদী। সুখদহ নদীতে এখন আর মাছ দেখা যায় না। ময়লা আবর্জনা জমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সুযোগ সন্ধানীরা ধান চাষ করে আবার কেউ কেউ বিভিন্ন এলাকায় পাড় দখল করে রেখেছে। নদীটি প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ হলেও খালে পরিণত হয়েছে। জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলাটি যমুনা, বাঙালী, ইছামতি এবং সুখদহ নদী বিধৌত। তিনটি নদীর মধ্যে যমুনা নদী ভরা মৌসুমে প্রবল বন্যাসহ তার খরস্রোতা রূপ ধারণ করে। কিন্তু বাঙালী, ইছামতি এবং সুখদহ নদীতে শুধুমাত্র বর্ষার মৌসুমে পানি থাকে। আর এই পানি দিয়ে স্থানীয়রা একসময় কৃষিকাজ করতো।
জানা যায়, যমুনা নদী ৪০ বছর আগে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি সদর, ধুনট ও সোনাতলা উপজেলা থেকে ৪৫ কিলোমিটার পূর্বে ময়মনসিংহ জেলার পশ্চিম সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হতো। বর্তমানে সারিয়াকান্দি শহর হতে যমুনা নদীর দূরত্ব মাত্র কয়েকশ মিটার। ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের বৈচিত্র্যময় এ নদীটির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ভুতাত্ত্বিকদের ধারণা হিমালয় পর্বতমালা উত্থানের পূর্বে যমুনা নদীর আদি নাম ছিল ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র নদ হিমালয় পর্বতের কৈলাশ শৃঙ্গের একটি হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে চীন, তিব্বত, ভুটান ও ভারতের আসামের মধ্য দিয়ে কুড়িগ্রামের নুন খাওয়া নামকস্থানে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীটি বগুড়ার শেষ সীমানা শেরপুর ও ধুনট উপজেলার মধ্য দিয়ে রাজবাড়ি গিয়ে গোয়ালন্দঘাটে পদ্মার সাথে মিশেছে। আন্তর্জাতিক নদী গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে, যমুনা নদী এককালে রংপুর, বগুড়া, পাবনা ও ময়মনসিংহ জেলার পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
১৯৭৭ সালে শুরু হয় নদী শাসনের কাজ। ১৯৮৬ সালে সারিয়াকান্দির প্রধান পয়েন্টে কালিতলায় একটি গ্রোয়েন বাঁধ নির্মিত হয়। এরপর ১৯৯৬ সাল হতে শুরু করে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রোয়েন বাঁধটির পুনঃনির্মাণ কাজ শেষ করে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়। সর্বমোট ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটির নামকরণ করা হয় যমুনা এবং বাঙালি নদী একীভূতকরণ রোধ। প্রকল্পের আওতায় সদর ইউনিয়নের দীঘলকান্দি এবং কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের দেবডাঙায় দুইটি বড় হার্ডপয়েন্ট নির্মাণ করা হয়। এছাড়া ধুনট সীমানা হতে সারিয়াকান্দির হাটশেরপুর ইউনিয়নের হাসনাপাড়া বাজার পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৮ সাল হতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যমুনা নদীর ডান তীর সংরক্ষণের কাজ করা হয়। এর মধ্যে ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৬ সালে কালিতলা গ্রোয়েন বাঁধ হতে পারতিতপরল গ্রাম পর্যন্ত ২ হাজার মিটার এবং দেবডাঙা পয়েন্টে ১ হাজার ২০০ মিটার তীর সংরক্ষণ কাজ হয়েছে। ২০০৬ সালের পর পারতিতপরল গ্রাম হতে হাসনাপাড়া পর্যন্ত তীর সংরক্ষণ কাজ হয়। ২০১৬ সালে রৌহাদহ হতে মথুরাপাড়া পর্যন্ত ৬ কিঃ মিঃ তীর সংরক্ষণ কাজ হয় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে। ফলে উজান থেকে বয়ে আসা পলিজমে উপজেলার চালুয়াবাড়ী, হাটশেরপুর, কাজলা, কর্নিবাড়ী এবং সারিয়াকান্দি সদরের মৌজায় বিশালাকার আয়তনের চরাভূমির সৃষ্টি হয়েছে। নদী শাসনের কাজগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য যমুনা নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে এখন বাম তীর ঘেঁষে জামালপুরের সীমানার কাছাকাছি অবস্থান করছে।
সারিয়াকান্দি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কাফি মন্ডল জানান, যমুনা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে উপজেলার চারটি ইউনিয়নের মৌজার জমিগুলো পুনরায় জেগে উঠেছে। এসব জমিগুলোতে নানা ধরনের কৃষি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়াও সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটফুলবারী এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া সুখদহ নদীটি খনন করে দিলে এর নাব্যতা পুনরায় ফিরে পাবে। নদীপথে পুনরায় যোগাযোগ শুরু হবে এবং কৃষি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ নাজমুল হক জানান, ১৯৮৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গত আড়াই দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সারিয়াকান্দি এলাকায় যমুনা নদীর ডানতীরে প্রায় ৫৬০ মিটার ভেঙেছে। ২০১০ সালের পর থেকে সরকারিভাবে নদী শাসনের কাজ হওয়ায় এই এলাকায় বন্যায় বড় আকারে ভাঙেনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে নদী ভাঙন রোধে কাজ করা হয়েছে। ভাঙন কবলিত এলাকায় ব্লক ও বালি ভর্তি বস্তা ফেলা হয়েছে। বন্যায় যেন বড় ধরনের ক্ষতি না হয় সেজন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতি বছর উজান থেকে হাজার হাজার টন পলি নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে। যে কারণে নদীগুলো মরে যাচ্ছে।