প্রায় চার বছর ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই প্রথমবারের মতো বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) দুদিনের সফরে যাচ্ছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি উভয় দেশের আয়োজিত বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেবেন।
এছাড়া উভয় দেশের মধ্যে বেশ কিছু চুক্তি সই হওয়ার কথা রয়েছে। ভারত ও রাশিয়া বহু দশক ধরে ঘনিষ্ঠ মিত্র। পুতিন ও মোদির মধ্যেও সম্পর্ক বেশ উষ্ণ। সফরটি এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করতে চাপ দিয়ে আসছে। অন্যদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করতে রুশ প্রশাসনের সঙ্গেও আলোচনা চালাচ্ছেন মার্কিন প্রতিনিধিরা।
তবে তেল কেনার ওপর ভারতকে অব্যাহক চাপ, উত্তেজনা, রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে ভারতের দীর্ঘস্থায়ী ভারসাম্য রক্ষার কাজকে আরও সূক্ষ্ম করে তুলেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়ে, পুতিনের সফরের কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত থামাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।
পুতিনের সাথে তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রেই বেলোসভ এবং ব্যবসা ও শিল্পের একটি বিস্তৃত প্রতিনিধিদল সফরে অংশ নিয়েছেন। এর যার রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় অস্ত্র রপ্তানিকারক রোসোবোরোনেক্সপোর্টের শীর্ষ নির্বাহী এবং নিষিদ্ধ তেল সংস্থা রোসনেফ্ট এবং গ্যাজপ্রম নেফ্টের প্রধানরা থাকবেন বলে জানা গেছে।
পুতিনের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রথম বছরে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যদিও ভারত ও রাশিয়া তাদের সম্পর্ককে ভৌগোলিক পরিবর্তনের মধ্যে স্থিতিশীল বন্ধুত্বের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে পছন্দ করে, তবুও তাদের সম্পর্ক অন্যান্য দেশের চাপের মুখে পড়েনি।
২০০০ সাল থেকে নয়াদিল্লি এবং মস্কোতে বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনের একটি ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এক বছর রাশিয়া সফর করবেন এবং পরের বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভারতে যাবেন। তবে ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত করা হয়।
২০২৩ সালে পুতিন নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য ভারত সফর এড়িয়ে যান। পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে পুতিন তেমন বিদেশ ভ্রমণ করতেন না। তবে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে পশ্চিমা সদস্যরা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তারা রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির সাথে কক্ষ ভাগাভাগি করতে অস্বস্তি বোধ করবেন।
অবশেষে ২০২৪ সালে আবারও ভারত-রাশিয়ার মধ্যে বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়। মোদি রাশিয়া সফর করেন। সেই সম্মেলনের অংশ হিসেবে পুতিন চার বছর পর নয়াদিল্লি সফর করছেন।
বাণিজ্য বিশ্লেষক এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, পুতিন ভারতকে আরও রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং যুদ্ধবিমান কেনার জন্য চাপ দেবেন। এতে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার হবে এবং ওষুধ, যন্ত্রপাতি এবং কৃষি পণ্যসহ বাণিজ্য সম্প্রসারণের আরও ক্ষেত্র খুঁজে বের করা সহজ হবে।
মার্কিন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ক্রাইসিস গ্রুপের ভারতের একজন সিনিয়র বিশ্লেষক প্রবীণ দোন্থি আল জাজিরাকে বলেন, ট্রাম্পের শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপের পর ভারতের উপর তীব্র চাপের মধ্যে এই সম্মেলন উভয় দেশের বিশেষ সম্পর্ক আরও জোরদার করার সুযোগ হয়েছে।
নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক গবেষণার অধ্যাপক রাজন কুমার বলেন, এই সফরের মাধ্যমে পুতিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও একটি জোরালো বার্তা পাঠাতে পারেন যে রাশিয়া বিশ্বে বিচ্ছিন্ন নয়। অন্যদিকে ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য পুতিন যখন চাপের মুখোমুখি হচ্ছেন, তখন গণতন্ত্র রাশিয়াকে স্বাগত জানাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বিশ্বে অপরিশোধিত তেলের তৃতীয় বৃহত্তম ভোক্তা হলো ভারত। তারা রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ তেল কিনছে। তবে এ চিত্র সবসময় এমন ছিল না। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ভারতের মোট তেল আমদানির মাত্র ২.৫ শতাংশ ছিল রাশিয়ার তেল। সেটি এখন বেড়ে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। কারণ ভারতকে রাশিয়া বড় ধরনের মূল্য ছাড়ের সুযোগ দিয়েছে। মূলত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও ইউরোপীয় বাজারে সীমিত প্রবেশাধিকারের অবস্থা কাটিয়ে উঠতেই রাশিয়া এমন উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু এতে নয়াদিল্লি খুশি হলেও নাখোশ হয় ওয়াশিংটন।
প্রতিরক্ষা খাতেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে রাশিয়া থেকে কম এবং তাদের কাছ থেকে বেশি কেনার জন্য চাপ দিচ্ছে।ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক দোন্থি বলেন, নয়াদিল্লি মস্কোর সাথে তার প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে ওয়াশিংটনকে বিরক্ত করার বিষয়ে সতর্ক, তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করা থেকে তাদের বিরত রাখতে পারছে না। তার মতে, ভারত রাশিয়ার সাথে একই ধরণের চুক্তি করে মার্কিন সমালোচনাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং রাশিয়ায় নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত কানওয়াল সিবাল বলেছেন, ট্রাম্প এবং আমেরিকা প্রশাসন ‘দ্বৈত মান’ প্রয়োগ করছে।
আগস্টে ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ সম্মেলনের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প আলাস্কায় পুতিনের জন্য লাল গালিচা বিছিয়ে দিতে পারেন। তাহলে কেন ভারত এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত নয়? ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক জ্বালানি সম্পর্ক বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হলেও, তাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও স্থিতিশীল বলেও জানান তিনি।
রাশিয়া ভারতের বৃহত্তম প্রতিরক্ষা সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত। অস্ত্র আমদানির প্রায় ৩৬ শতাংশ এবং ভারতের বিদ্যমান অস্ত্রাগারের ৬০ শতাংশেরও বেশি সরবরাহ করে রাশিয়া।
ভারত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলি থেকে আরও বেশি অস্ত্র কেনার চেষ্টা করার কারণে আমদানির সংখ্যা ২০১০ সালে ৭২ শতাংশ থেকে কমে এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের বিশিষ্ট প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে রাশিয়ার অবস্থান সম্ভবত কয়েক বছর ধরে অপ্রতিরোধ্য থাকবে।
ড়ত মে মাসে পাকিস্তানের সাথে চার দিনের বিমান যুদ্ধের সময় রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারতের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ভারতের বিমান বাহিনী প্রধান মার্শাল এপি সিং বলেছেন, এস-৪০০ ভারতের ভারতের জন্য একটি ‘গেম চেঞ্জার’।
আন্দ্রে কোলেসনিকভ আরও বলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো রাশিয়া আবারও বিশ্বের এই অংশগুলোর প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে ফিরে এসেছে। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানি ও ফ্রান্সের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল। তবে সেটি ছিল বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি।’
দার্শনিকরা প্রায়ই বলেন রাশিয়া ইউরোপের অংশ। আন্দ্রে কোলেসনিকভ বলছেন, ‘এখন আমরা তা আর নই। আমরা ইউরোপ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। এটি একটি বড় ব্যর্থতা। আমি নিশ্চিত যে রাশিয়ার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণির একটি অংশ আবার ইউরোপে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তারা শুধু চীন ও ভারতের সঙ্গে নয়, ইউরোপের সঙ্গেও ব্যবসা করতে চায়।’
পুতিনের প্রেস সচিব দিমিত্রি পেসকভ বলেন,সুখোই-৫৭ বিশ্বের সেরা বিমান।নয়াদিল্লি এখন অতিরিক্ত এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে চাইছে। রাশিয়া ভারতকে তার পঞ্চম প্রজন্মের সুখোই-৫৭ স্টিলথ ফাইটার জেট বিক্রি করতে চায়। শীর্ষ সম্মেলনের আগে পু, সুখোই-৫৭ বিশ্বের সেরা বিমান। শীর্ষ সম্মেলনে এটি এজেন্ডায় উল্লেখ থাকবে।

