পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি, কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

0
পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি, কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

সম্প্রতি সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি ঐতিহাসিক প্রতিরক্ষা চুক্তি মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বুধবার রিয়াদের আল-ইয়ামামাহ প্যালেসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উপস্থিতিতে এই ‘পারস্পরিক কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই চুক্তি দুই দেশের প্রায় আট দশকের পুরনো সম্পর্কে একটি নতুন মাইলফলক। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই চুক্তি উভয় দেশের নিরাপত্তা জোরদার করবে এবং আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, কোনো একটি দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। যা ভবিষ্যতে যৌথ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করবে।

এই চুক্তি এমন এক সময়ে হলো যখন মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থির। গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলের আগ্রাসন, বিশেষ করে গাজায় যুদ্ধ এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে হামলার ঘটনা, উপসাগরীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষত, সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েলের হামলার পর এই অঞ্চলের দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।

ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক স্টিমসন সেন্টারের সিনিয়র ফেলো আসফান্দিয়ার মীর এই চুক্তিকে যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান এর আগে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছিল, যা ১৯৭০-এর দশকে ভেঙে যায়। এমনকি চীনের সঙ্গেও পাকিস্তানের ব্যাপক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা থাকলেও কোনো আনুষ্ঠানিক পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি নেই।

সিডনি ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির গবেষক মুহাম্মদ ফয়সাল মনে করেন, এই চুক্তি পাকিস্তান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বা কাতারের মতো অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের সঙ্গেও অনুরূপ প্রতিরক্ষা চুক্তির পথ খুলে দিতে পারে। তিনি বলেন, এর ফলে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ এবং প্রতিরক্ষা উৎপাদনে সহযোগিতা বাড়বে এবং সৌদি আরবে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপস্থিতি আরও জোরদার হতে পারে।

এই চুক্তিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ভারত। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মে মাসে চার দিনের সংক্ষিপ্ত সামরিক সংঘর্ষের পর আরও প্রকট হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, ভারত এই চুক্তির প্রভাব তাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর কীভাবে পড়তে পারে তা খতিয়ে দেখবে।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই চুক্তির ফলে পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতা কিছুটা কমতে পারে। কারণ, গত এক দশকে সৌদি আরব অর্থনৈতিক সংকটে থাকা পাকিস্তানকে আর্থিক সহায়তা দিলেও ভারতের সঙ্গেও নিজেদের সম্পর্ক গভীর করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত এপ্রিলে এক দশকে তৃতীয়বারের মতো সৌদি আরব সফর করেন।

আসফান্দিয়ার মীর বলেন, এই চুক্তি প্রমাণ করে যে সৌদি আরব এখনও পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের গুরুত্ব অনুভব করে। ভারতের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তান তার প্রতিবেশীদের মধ্যে একা নয়। তিনি আরও বলেন, এই চুক্তি ভবিষ্যতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের গতিপ্রকৃতিতে নতুন জটিলতা তৈরি করবে।

এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা নিয়ে। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের একটি পুরোনো মন্তব্য নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে তার পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম দরকার নেই, কারণ তিনি পাকিস্তান থেকে এটি কিনে নেবেন।

তবে ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাহার খান বলেন, এই চুক্তিতে পারমাণবিক নিশ্চয়তা বা ‘পারমাণবিক ছাতা’র কোনো ইঙ্গিত নেই। তিনি বলেন, পাকিস্তান এর আগেও প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে কিন্তু সেগুলোর কোনোটিই পারমাণবিক নিশ্চয়তার দিকে পরিচালিত হয়নি।

মুহাম্মদ ফয়সালও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, চুক্তিটিতে কোনো একটি দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে উভয়ের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলা হলেও এটি হয়তো বর্তমানে একটি রাজনৈতিক বিবৃতি মাত্র, কোনো আনুষ্ঠানিক সামরিক জোট নয়। তবে তিনি স্বীকার করেন, এর ফলে দুই দেশের রাজনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা সমন্বয় আরও গভীর হবে।

সূত্র: আল জাজিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here