দিল্লি বিস্ফোরণে অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যরা কী বলছে

0
দিল্লি বিস্ফোরণে অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যরা কী বলছে

দিল্লির লাল কেল্লার কাছে বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে প্রথম ব্যক্তিকে ১৬ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)। সিবিআই-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আমির রশিদ আলি নামে ওই ব্যক্তি কাশ্মীরের বাসিন্দা। তিনি ডা. উমর উনের সহযোগী ছিলেন এবং দিল্লি বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে লাল কেল্লার কাছে ১০ নভেম্বর একটি গাড়ি বিস্ফোরণে কমপক্ষে ১২ জনের মৃত্যু হয়। যাদের বিরুদ্ধে ওই বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলা হয়েছে, তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি।

ডা. উমর উনের পরিবার কী বলছে
এনআইএর দাবি, লাল কেল্লার কাছে বিস্ফোরণের ঘটনায় ‘আত্মঘাতী হামলাকারী’ ছিলেন চিকিৎসক উমর উন। অভিযোগ, যে গাড়িতে ওইদিন বিস্ফোরণ ঘটেছিল, সেটি উমর উন চালাচ্ছিলেন। শ্রীনগর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে পুলওয়ামা জেলার কোইল গ্রামে তার বাড়ি।

শ্রীনগর থেকে কোইল গ্রামে যেতে হলে আরো বেশ কয়েকটি গ্রাম পেরিয়ে যেতে হয়। গ্রামের একটি সরু গলি তার বাড়ির দিকে চলে গেছে। দিন কয়েক আগে, রাতের বেলায় তার বাড়িটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে ভেঙে ফেলে নিরাপত্তা বাহিনী। এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বাড়িটি।

বাড়ি ভেঙে ফেলার পরের দিন তার প্রতিবেশীরা জানিয়েছিলেন, রাত ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত তারা তিনটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। উমর উনের ওই বাড়ির আশপাশে যারা বসবাস করতেন প্রথমে তাদের বাড়ি খালি করতে বলা হয়। তারপর বিস্ফোরণের মাধ্যমে ভেঙে ফেলা হয় উমর উনের বাসভবন।

তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন, তার মা-বাবা, ভাই, ভাবি ও এক বোন। উমর উনের ভাইয়ের স্ত্রী মুজাম্মিল আখতার বিবিসি নিউজ হিন্দিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, দেড় বছর আগে কাশ্মীর থেকে চলে যান ওই চিকিৎসক। ফরিদাবাদের আল ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করতেন তিনি।

মুজাম্মিল আখতার বলেছেন, ‘মাসদুয়েক আগে ও (উমর উন) শেষবার বাড়ি এসেছিল। গত শুক্রবার আমি উমরের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম। ওর বাড়িতে আসার কথা ছিল। এখন আমরা ওর সম্পর্কে এসব শুনছি। দেড় বছর আগে ও অনন্তনাগের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে কাজ করত। পরে কাজের জন্য ফরিদাবাদে চলে যায়’।

পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন শ্রীনগরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ (জিএমসি) থেকে এমবিবিএস এবং এমডি পাস করেন উমর উন। মুজাম্মিল আখতার জানিয়েছেন, এই বাড়ি ছাড়া তার অন্য কোনো সম্পত্তি বা জমি নেই। তিনি জানিয়েছেন, পরিশ্রম করে উপার্জন এবং জীবনযাপন করতেন তারা।

তার আরেক আত্মীয় তাবাসসুম আরা বিবিসিকে বলেন, ‘ওর মা সংসারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। উমরের মা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছেন।’ কিছুদিন আগেই ডা. উমর উনের বাগদান হয়েছিল বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আমির রশিদ আলি কে
পুলওয়ামার সাম্বুরা গ্রামের বাসিন্দা আমির রশিদ আলিকে দিল্লির লাল কেল্লার কাছে বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার করেছে এনআইএ। তার বয়স ৩০ বছর। পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, প্লাম্বার বা মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন তিনি। সাম্বুরায় একটি দোতলা বাড়িতে বাস করে তার পরিবার।

আমির রশিদ আলির পরিবারে রয়েছেন তার মা, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী। তার বড় ভাই উমর রশিদ ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন, তাকেও আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। উমর রশিদ বিবাহিত এবং এই দম্পতির এক সন্তান রয়েছে। আমির রশিদ আলি অবশ্য অবিবাহিত। উমর রশিদের স্ত্রী কুলসুম জান জানিয়েছেন, গত ১০ নভেম্বর গভীর রাতে পুলিশ দুই ভাইকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।

তার কথায়, ‘তখন রাত ১১টা বাজছিল। আমাদের বাড়িতে পুলিশ এসে পৌঁছয়। তারা আমির ও উমর- দুই ভাইকেই সঙ্গে নিয়ে যায়। পুলিশ আমাদের বলেছিল যে ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরদিন সকালে আমরা পাম্পোর থানায় যাই, কিন্তু সেদিন আমাদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তৃতীয় দিন আমরা আবার থানায় যাই। সেদিন উমরের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয় আমাদের। পুলিশ আমাদের জানায় ওর বিরুদ্ধে তদন্ত কিছু নিয়ে চলছে এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’। সেইদিন সন্ধ্যায় গ্রাম প্রধানের কাছে পুলিশের ফোন আসে।

কুলসুম জান বলেন, ‘ওই দিন সন্ধ্যায় গ্রাম প্রধানের কাছে পুলিশের ফোন আসে। তাকে জানানো হয় আপনারা থানায় এসে উমরকে নিয়ে যেতে পারেন। আমরা তার সঙ্গে থানায় যাই এবং উমরকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনি। পুলিশ আমাদের বলেছিল পরের দিন সকাল ১০টায়, উমরকে রিপোর্টের জন্য থানায় আসতে হবে।’

তিনি আরো জানান, ওই দিন সন্ধ্যায় এনআইএ টিমের সদস্যরা এসে উপস্থিত হন এবং উমর রশিদকে পদিন সকাল আটটায় শ্রীনগরের ডাল গেটের কাছে তাদের অফিসে যাওয়ার কথা বলেন।

কুলসুম জান জানিয়েছেন, পরের দিন নির্দেশ মতো তারা উমর রশিদকে থানায় নিয়ে যান এবং তারপর তাদের কিছু জানা নেই।

তবে ১০ নভেম্বরের পর থেকে আমির রশিদ আলির সঙ্গে দেখা হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি উমর রশিদ কখনো দিল্লি যাননি বলেও দাবি করেছেন তার স্ত্রী।

তিনি বলেছেন, ‘ও দিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরত, খাওয়া-দাওয়া করত, আর তারপর ঘুমিয়ে পড়ত। এখন ওকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। আমরা যা জানি, সেটাই আপনাদের জানাচ্ছি’।

আমির রশিদ আলির পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ২০২০ সাল থেকে প্লাম্বারের কাজ করেন। এর আগে তিনি শাল তৈরি করতেন বলে জানিয়েছেন তারা।

শালের তৈরিতে লোকসান হওয়ার কারণে সেই কাজ ছেড়ে দেন তিনি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন আমির রশিদ আলি। তার ভাই উমর রশিদ দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

তাদের মা সাম্বুরা গ্রাম থেকে বিবিসি হিন্দিকে জানিয়েছেন, ছেলে সম্পর্কে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

তিনি আরো বলেছেন, ছেলে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, তা জানতে কি বাবা- মায়ের পক্ষে তার পিছু পিছু ঘোরা সম্ভব?

আমির রশিদ আলির মা বলেন, ‘আর পাঁচজনের মতো আমিরও বাড়ির সব কাজ করত। এবার ধান কাটার জন্য আমরা কাউকে পাইনি। ও একাই ফসল কেটেছে। আমি যা কাজ করতাম তাতে সাহায্য করত। প্রতিবেশীরা ওকে কোনো কাজ বললে ও কখনোই না বলত না। আমি ঈশ্বরের কসম খেয়ে বলছি, ওকে কোনো কিছু নিয়েই সন্দেহ করি না আমরা। আমি কিন্তু আপনাদের মিথ্যে বলছি না। ওর বিরুদ্ধে কখনো কোনো মামলা দায়ের হয়নি। ওর পুলিশ রেকর্ডও স্বচ্ছ। যখন এখানে পাথর ছোঁড়া হচ্ছিল, তখন অনেককে ধরা পড়েছিল বা অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল, কিন্তু এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে কখনো কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। ওদের কেউ কখনো স্পর্শ করেনি।’ ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

আমির রশিদ আলির বিষয়ে এনআইএ যা বলছে
দিল্লির লাল কেল্লার কাছে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)।

সংস্থার পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয়েছে, এই ঘটনায় একজন কাশ্মীরি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই ব্যক্তি আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করেছিলেন।

অভিযুক্তের নাম আমির রশিদ আলি বলে জানানো হয়েছে। সংস্থার তরফে এও উল্লেখ করা হয়েছে, হামলায় যে গাড়িটি ব্যবহার করা হয়েছিল সেটি আমির রশিদ আলির নামে রেজিস্ট্রি করা।

আমির রশিদ আলিকে দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে এনআইএর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।

প্রেস বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এনআইএর তদন্তে জানা গেছে জম্মু ও কাশ্মীরের পাম্পোরের সাম্বুরার বাসিন্দা ওই অভিযুক্ত কথিত আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী উমর উনের সঙ্গে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর ষড়যন্ত্র করেছিল’।

এনআইএ জানায়, আইইডি হিসেবে ব্যবহৃত ওই গাড়িটি কেনার সময় সাহায্য করতে দিল্লিতে এসেছিলেন আমির রশিদ আলি। তদন্তকারী সংস্থা আরো জানিয়েছে, ডা. উমর উনেরও একটি গাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়, এই মামলায় প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের জন্য ওই গাড়িটি পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৭৩ জন সাক্ষীর বক্তব্য নথিভুক্ত করা হয়েছে বলেও এনআইএর তরফে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে দিল্লি বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিরাও রয়েছেন।

আরো এক ব্যক্তি গ্রেপ্তার
দিল্লি বিস্ফোরণ মামলায় এনআইএ সোমবার অর্থাৎ ১৭ নভেম্বর দ্বিতীয় ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। সংস্থার তরফে জানানো হয় শ্রীনগর থেকে কাশ্মীরের বাসিন্দা জসির বিলাল ওয়ানি ওরফে দানিশকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, দিল্লি বিস্ফোরণের আগে ড্রোন এবং রকেট তৈরির চেষ্টা করে হামলা চালানোর জন্য কথিতভাবে প্রযুক্তিগত সহায়তা করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।

সংস্থার দাবি, উমর উনের সঙ্গে বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন জাসির বিলাল ওয়ানি। তার বাবা বিলাল আহমেদ ওয়ানি দুই দিন আগে গায়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এরপর তাকে চিকিৎসার জন্য শ্রীনগরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সোমবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় বিলাল আহমেদ ওয়ানির।

বিলাল আহমেদ ওয়ানির ভাবি নাসিমা আখতার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমার বোনজামাই বিলাল আহমেদ আত্মহত্যা করেছেন, কারণ তার অসম্মান হচ্ছিল। আদিল নামে যে ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিনি আমাদের প্রতিবেশী। আমরা কী করে জানব তিনি কে? মা-বাবা সবসময় তার সন্তানকে ভালো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে বলেন। কিন্তু কে কেমন সে বিষয়ে আমরা কী করে জানব? একজন ভুল করলে সবাইকে শাস্তি দেওয়া যায় না’।

নাসিমা আখতারের স্বামী নাবিল আহমেদ ওয়ানি একজন লেকচারার। তাকেও পুলিশ আটক করে।

নাসিমা বলেন, ‘আমার স্বামী নাবিল আহমেদ ওয়ানি একজন লেকচারার, তাকেও পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। যে সময় পুলিশ তাকে ধরে, তখন তিনি ডিউটিতে ছিলেন। দানিশকেও ধরেছে। আমরা নির্দোষ মানুষ। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি তাদের যেন মুক্তি দেওয়া হয়।’

সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর থেকে চিকিৎসক আদিলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here