টেলিগ্রামে ভয়ংকর প্রতারক চক্র

0

ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ অ্যাপ ‘টেলিগ্রাম’ পরিণত হয়েছে অপরাধীদের লেনদেনের হাতিয়ারে। মাদক বেচাকেনা, নিষিদ্ধ ক্রিপটোকারেন্সি কেনাবেচা, নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে বেচাকেনা, দেহব্যবসা, হানিট্র্যাপ, পিগ বুচারিং (আর্থিকভাবে লাভবানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা), জুয়াসহ হাজারটা প্রতারণা ও অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে অ্যাপটি। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে রাতারাতি নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। অনেকে নিষিদ্ধ নেশার প্রলোভনে পড়ে ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়ে দিনের পর দিন অপরাধীদের নাচের পুতুলে পরিণত হয়েছেন। অজানা আতঙ্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হতেও দ্বিধাবোধ করছেন প্রতারিত অনেকে।

২৩ ডিসেম্বর একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর (+৮৮০ ১৯২৮-৬৬১৬৪) থেকে খুদে বার্তা আসে রেদোয়ানের মোবাইলে। ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সির কর্মী পরিচয় দিয়ে অনলাইনে বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় রিভিউর কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয়। রাজি হয়ে মাত্র ১০ সেকেন্ডে পরীক্ষামূলক একটি রিভিউ দিয়ে বিকাশে পেয়ে যান ২১০ টাকা। এরপর তাকে যুক্ত করা হয় গোল্ডেন ড্রিম-৮২২৩ নামে একটি টেলিগ্রাম গ্রুপে। প্রতি চারটি রিভিউর টাকা একসঙ্গে দেওয়া হয়। সেখানে প্রথম চারটি রিভিউর জন্য ৫০ করে আরও ২০০ টাকা পান। এত সহজ কাজ করে ঘরে বসেই লাখ টাকা আয়ের স্বপ্ন রেদোয়ানকে আশাবাদী করে তোলে। পরের তিনটি রিভিউর জন্য জমা হয় ৩০০ টাকা। তবে চতুর্থ কাজটির জন্য রেদোয়ানকে জমা দিতে হবে ১ হাজার ৫০০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। ১ হাজার ৫০০ জমা দিলে ফেরত পাওয়া যাবে আগের ৩০০সহ ২ হাজার ৪০০ টাকা। ৮০ হাজার দিলে মিলবে ১ লাখ ১০ হাজার। দেড় হাজার পাঠিয়ে দেন রেদোয়ান। তবে কিছুই ফেরত পাননি।

রেদোয়ান বলেন, ‘গ্রুপটিতে ৩ হাজারের বেশি সদস্য ছিলেন। প্রতিদিন গ্রুপে ২৪টি রিভিউর কাজ দিতে দেখতাম। গ্রুপের সদস্যদের ১১ থেকে ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বিকাশে পেতে দেখতাম। তারা স্ক্রিনশট শেয়ার করতেন। অনেককে ৮০ হাজার টাকা ডিপোজিট করতে দেখেছি। এখন বুঝছি, যারা এ লেনদেন করতেন তাদের অধিকাংশই একই চক্রের লোক। নতুন সদস্য ঢুকিয়ে প্রতারণা করা হতো। ৩ হাজারের বেশি সদস্য থাকলেও কাজ করতেন ৬০-৭০ জন। অর্থাৎ অন্যরা প্রতারিত হয়েছেন। ২ জানুয়ারি সকালে গ্রুপের মেসেজ আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘০১৯৪২৬৮৬৩০৩, ০১৮৭৪৫২১০২৮, ০১৮৯৪০৫৭৭৩৬, ০১৮৯৮৬৪৯৯৮৫সহ ডজনখানেক বিকাশ নম্বর ও কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করা হতো। পরে আরও কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে আমাকে কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’ টেলিগ্রামে হানিট্র্যাপ দিয়ে ব্ল্যাকমেলের ঘটনাও ঘটছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্পা ও এজেন্সির নামে গড়ে উঠেছে দেহব্যবসার রমরমা ডিজিটাল বাজার। সেখানে দেওয়া হচ্ছে স্বল্পবসনা নারীদের ছবি ও প্যাকেজ। তবে একবার এদের ফাঁদে পা দিলে কাঁদতে হচ্ছে সারাজীবন। গোপন ভিডিও তৈরি করে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে দিনের পর দিন। এ ছাড়া মাদক বেচাকেনার ভূরি ভূরি গ্রুপ ও চ্যানেল টেলিগ্রামে গড়ে উঠেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তবে এসব গ্রুপে যুক্ত হতে লাগে অন্যের সুপারিশ।

এর আগে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে ‘লাখ লাখ’ মানুষের তথ্যফাঁসের ঘটনা ঘটে। পরে ৫ কোটি নাগরিকের স্মার্ট কার্ডের তথ্য বেহাত হয়। টেলিগ্রাম চ্যানেলে অল্প টাকার বিনিময়ে এসব তথ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ওয়েবসাইট ও তথ্যভান্ডারের ‘অ্যাডমিন প্যানেলে’ (নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা) প্রবেশের কয়েক হাজার আইডি ও পাসওয়ার্ডও ফাঁস হয়। ফাঁস হওয়া তথ্য ইন্টারনেটের অপরাধজগৎ ডার্ক ওয়েব ও টেলিগ্রামের বিভিন্ন চ্যানেলে বিক্রি হয়, যা দেশের ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘টেলিগ্রামে বিভিন্ন প্রতারণার বিষয় আমাদের নজরে এসেছে। প্রতারকদের শনাক্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের টিম কাজ করছে। অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here