ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় স্থলঅভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েল। নির্বিচার বোমা হামলার মধ্যেই এই স্থল আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। এ সময় গাজায় যেন কোনোভাবেই ইন্টারনেট, মুঠোফোন নেটওয়ার্কের সংযোগ না থাকে, তা নিশ্চিত করেছে ইসরায়েল। ফলে অমানবিক আগ্রাসনের নির্যাতনে দিন কাটানো ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারেননি। রবিবার আংশিক সংযোগ ফেরার আগে ৩৪ ঘণ্টা গাজাবাসীরা তাদের নিত্য ট্রাজেডিগুলো সম্পর্কে জানাতে পারেননি। বহির্বিশ্ব সেখানকার নৃশংস ঘটনার বিষয়ে ছিল অন্ধকারে।
জনবহুল আর বসতিপূর্ণ সরু এক চিলতে ভূখণ্ড গাজা উপত্যকা। এরমধ্যে উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ, চারদিকে ধবংসস্তূপ। বোমায় নির্বিচারে প্রাণ যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। এর মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। ধ্বংসস্তূপের নিপে চাপা পড়ে আছে বহু সংখ্যক লাশ। অবরুদ্ধ উপত্যকায় নেই খাদ্য, পানি বা বিদ্যুৎ। এত ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। বিভৎস, নিরুপায় এক বাস্তবতার মুখোমুখি গাজার প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দা।
টানা তিন সপ্তাহ ধরে গাজায় বোমা ফেলার পর শুক্রবার সন্ধ্যায় সেলফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গাজায় সেলফোন ও ইন্টারসেট সেবা দুর্বল, যুদ্ধকালে যা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়ে। তবু মানুষ কোনোরকমে যোগাযোগের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু, শুক্রবার সে উপায়ও স্তব্ধ হয়ে পড়ে। এমন সময়ে তা হয়, যখন গাজাবাসী তাদের ওপর ইসরায়েলি স্থল অভিযান যেকোনো মুহূর্তে শুরু হওয়ার আশঙ্কায়, আতঙ্কে দিনাতিপাত করছিল। পুরো বিশ্বও অভিযানের বিবরণ জানতে চাইছিল।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে এ বিষয়ে মন্তব্য করা স্পর্শকাতর হওয়ায়, নাম না প্রকাশের শর্তে দেশটির দুজন কর্মকর্তা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার নেপথ্যে ছিল ইসরায়েল।
রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসার মুহূর্তে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার এ ঘটনায় পুরো উপত্যকাজুড়ে নিয়ন্ত্রণহীন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
রবিবার গাজায় ইন্টারনেট ও সেলফোন নেওয়ার্ক কিছুটা ফিরে আসে। এদিন তার ফেসবুক পোস্টে গাজা-নিবাসী সাংবাদিক ফাথি সাব্বাহ লেখেন, “আমার মনে হয়েছিল, অন্ধ ও কালা হয়ে হয়ে গেছি, কিছু দেখতে বা শুনতে পাচ্ছি না।”
গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে ১,৪০০ মানুষকে হত্যা করে এবং ২২৯ জনেরও বেশি মানুষকে জিম্মি হিসেবে নিয়ে যায়। সেদিন থেকে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ শুরু হয়।
চরম প্রতিশোধ নিতে মধ্যযুগীয় পন্থা নিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। জনবহুল গাজায় তারা বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি চিকিৎসা সরঞ্জাম, খাদ্যও আসতে দেয়নি। একইসময়ে অবিশ্রান্ত গোলা ও বোমা ফেলছে।
রবিবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, গাজায় শনিবার রাত থেকেই অভিযান শুরু করেছে তারা। এবং সেখানে তাদের সেনাসংখ্যা বাড়াচ্ছে। এসময় গাজার উত্তর অংশ থেকে বাসিন্দাদের অবিলম্বে দক্ষিণাঞ্চলে সরে যাওয়ার বিষয়ে আবারো হুঁশিয়ারি দেয়। কিন্তু, এর আগেও ইসরায়েলের হুমকির মুখে ঘরবাড়ি ছেড়ে দক্ষিণে পালানো মানুষের ওপর হামলা হয়েছে। বিমান হামলায় উদ্বাস্তুদের অনেককে হত্যা করা হচ্ছে।
হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই যুদ্ধ আঞ্চলিক উত্তেজনার বারুদের স্তূপে আগুন দিতে পারে। এরমধ্যেই লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর সাথে ইসরায়েলের গোলাগুলি বিনিময় হচ্ছে সীমান্তে। সম্প্রতি লেবানন থেকে একযোগে ১৬টি রকেট ইসরায়েলে নিক্ষেপ করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে, দক্ষিণ লেবাননে বিমান হামলা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নাজুক তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু মানবিক বিপর্যয় তার থেকেও গুরুতর।
গাজার একজন বাসিন্দা ও ৪৫ বছর বয়সী সরকারি চাকরিজীবী দেইর এল বালাহ বলেন, “ভেবেছিলাম, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভয়াবহ, এর চেয়ে খারাপ আর কি হতে পারে!”
এই পৌঢ়ের মন্তব্য, “কিন্তু, যোগাযোগের সুযোগ হারানোটা দেখি তার চেয়েও ভয়াবহ।”
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় কেবল যে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের খোঁজ নিতে পারেননি টানা ৩৪ ঘণ্টা, শুধু তাই-ই নয়, এমনকি পানি বিক্রেতার সাথেও যোগাযোগ করতে পারেননি। রুটি বিক্রেতার সাথেও নয়। ফলে এই সময়টা পরিবার নিয়ে সম্পূর্ণ অনাহারে কাটান বালাহ।
প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সাময়িক। অচিরেই সেই ভুল ভাঙে তার। বাড়ির ছাদে লাগানো সোলার প্যানেল থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ ব্যবহার করে কাতার-ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা দেখে বালাহ জানতে পারেন, গাজা সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ফিলিস্তিনের প্রধান টেলিযোগাযোগ কোম্পানি– প্যালটেল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আব্দুলমাজিদ মেলহেম জানান, রবিবার ভোররাত ৪টা থেকে তাদের সংযোগ আপনাআপনি ফিরতে শুরু করে।
কোম্পানিটি যুদ্ধকালে কোনো রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের কাজ করেনি, ফলে কীভাবে তা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল বা কীভাবেই তা আংশিকভাবে ফিরে আসে সে সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারেনি।
আব্দুলমাজিদ বলেন, তার ধারণা এর পেছনে ইসরায়েলি সরকারই দায়ী। অবশ্য সাম্প্রতিক যুদ্ধের শুরুর দিকেই কোম্পানির একটি টেলিযোগাযোগ টাওয়ারে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর থেকে বেশ সীমিতই হয়ে পড়েছিল তাদের সেবা প্রদান।
ইচ্ছাকৃতভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করতে চাননি ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
তবে দুজন মার্কিন কর্মকর্তা জানান, তারা তাদের ইসরায়েলি সমকক্ষদের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সচল করার তাগিদ দিয়েছিলেন।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনায় গাজা উপত্যকাজুড়ে জনমানুষের মধ্যে আতঙ্কের পাশাপাশি ক্ষোভও ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ-ফিলিস্তিনি নাগরিক ডা.ঘাসসান আবু সিত্তাহ লন্ডনে তার প্রাকটিস ছেড়ে গাজার একটি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তিনি সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’- এ লেখেন, “ফিলিস্তিনিরা নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার সময় মনে হয় খুব বেশি হইচই করেছেন। যেটা ইসরায়েলের সমর্থনদাতা পশ্চিমাদের একচোখা স্পর্শকাতরতায় আঘাত করেছে। তাই তারা আমাদের সমস্ত যোগাযোগের উপায় বন্ধ করে, স্তব্ধ করতে চেয়েছে।”
এভাবে বহির্বিশ্ব– এবং একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে – গাজার মানুষ যেন এক মহাদুর্যোগের চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুলোর মতো দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়।
গাজার সিভিল ডিফেন্সের এক কর্মকর্তা মাহমুদ বাসেল বলেন, দূরে বিস্ফোরণের ধোঁয়া বা অগ্নিকুণ্ড দেখে দিক আন্দাজ করে ছুটতে হয়েছে উদ্ধারকর্মীদের। কিছুক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকরা আহত মানুষকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে হাসপাতালে আনেন এবং সেখানে আসার পর হাসপাতালের মেডিক ও অ্যাম্বুলেন্স কর্মীদের দুর্গত স্থান সম্পর্কে জানান, যাতে তারা গিয়ে বাদবাকি আহতদের বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারেন।
গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন চিকিৎসা সেবা সংস্থার পরিচালক ইউসুফ আল লোহ জানান, কোনো কোনো আহত মানুষকে এক মাইলের বেশি পথ সাহায্যের জন্য ছুটতে হয়েছে, পুরোটা সময় তারা যন্ত্রণায় আর্ত-চিৎকার করেছে। উদ্ধারকারীরা যখন তাদের কাছে পৌঁছান, তখন রাগে-ক্ষোভে তারা উদ্ধারকারীদেরই গালমন্দ করেছেন। মানুষের মধ্যে ‘মানসিকভাবে’ চরম দুর্যোগের ধারণা তীব্র হওয়ারই লক্ষ্মণ এটি।
ইউসুফ এই যোগাযোগের ব্ল্যাকআউটকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এরজন্য দায়ীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।
তিনি বলেন, “এফ-১৬ জঙ্গিবিমানগুলো এত ঘন ঘন উড়ে এসে বোমা ফেলেছে, আমার মনে হচ্ছিল তারা যেন গাজাকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকেই মুছে ফেলতে চাইছে।”
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল-কিদরা জানান, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ৮ হাজারের বেশি গাজাবাসীকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩ হাজার জনের বেশি হলো শিশু।
টেলিযোগাযোগ কিছুটা ফিরে আসার পরে বিভিন্ন দুর্গত স্থানে গিয়ে শত শত আহত ও নিহতকে পরে থাকতে দেখেন অ্যাম্বুলেন্স ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। ধবংস হওয়া ভবনগুলোর মধ্যেও আটকা পড়া মানুষদের আর্তচিৎকার তারা শুনেছেন। রবিবারের এক সংবাদ সম্মেলনে এমন মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেন মুখপাত্র।
রবিবার ফিলিস্তিনে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া– জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) জানায়, হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তাদের গুদামগুলোতে অনুপ্রবেশ করে আটা-ময়দা ও অন্যান্য নিত্যপণ্য নিয়ে গেছে।
ইউএনআরডব্লিউএ’র গাজা উপত্যকা বিষয়ক পরিচালক থমাস হোয়াইট বলেন, “কয়েক সপ্তাহ ধরে যুদ্ধ ও কঠোর অবরোধ চলার পরিপ্রেক্ষিতে গাজায় সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার উদ্বেগজনক লক্ষণ হলো এ ঘটনা।”
তিনি বলেন, “ইন্টারনেট ও মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও উত্তেজনা চরম রূপ নেয়। গাজায় নিজদের পরিবারবর্গ ও বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না কেউ। তাদের সবারই মনে হয়েছে, তারা পরিত্যক্ত। নিজদের রক্ষার চেষ্টা নিজদেরই করতে হবে।”
শনিবারের ব্যাপক যোগাযোগ ব্ল্যাকআউটের মধ্যে হেলমি মৌসার মতো কতিপয় ব্যক্তির ইন্টারনেট সংযোগ ছিল। কিন্তু, এতে তার উদ্বেগ কোনো অংশেই কমেনি। কারণ, মাত্র এক মাইল দূরে থাকা আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি।
৭০ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত লেখক মৌসা এবং তার স্ত্রী বাসমা আতিয়া দুশ্চিন্তা ভারাক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের অ্যাপার্টমেন্টের নয়তলার ফ্ল্যাটে। ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনীদের কথাই তাদের মনে হয়েছে বারবার। বয়স্ক এই দম্পত্তি সন্ত্রস্ত ছিলেন পুরোটা সময়।
মৌসা বলেন, “চারদিকে একের পর এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটছিল– ডানে, বায়ে– সবদিকে। মনে হচ্ছিল, যেন ১০০ বিমান একসাথে গাজায় হামলা করছে– যেন এই উন্মাদনার আর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই– যেন তা কল্পনাকেও হার মানায়।”
এভাবেই ব্ল্যাকআউটের অন্ধকার জীবনের সাক্ষী হলো গাজাবাসী। তাদের দুর্ভোগের কাছে পরাজিত হলো বিশ্ব মানবতা। সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস