দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত হার এক-তৃতীয়াংশ পেরিয়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, এ পরিস্থিতির রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লাগবে। দুই বছর আগে মনে করেছিলাম, খেলাপি ঋণ ২৫ শতাংশ হতে পারে। এখন দেখি তা ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। শনিবার (২৯ নভেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৫’-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক, হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, বিএসএমএর সভাপতি ও জিপিএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং এবিবি চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন।
দেশের খেলাপি ঋণ বাড়ছে জানিয়ে অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, ‘প্রতি প্রান্তিকে যখন নতুন তথ্য পাই, খেলাপি ঋণের নতুন নিয়ম কার্যকর হয়। তখনই দেখা যাচ্ছে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। দুই বছর আগে আমার ধারণা ছিল, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ২৫ শতাংশের মতো হবে। তখন সরকার বলেছিল তা ৮ শতাংশ। এখন দেখছি এটি এরই মধ্যে ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।’
গভর্নর আরও বলেন, ‘দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে বহুদিন এই সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। ধাপে ধাপে এগোতে হবে। পুরোপুরি উত্তরণে অন্তত পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লাগবে।’
তবে আমদানি নিয়ে শঙ্কা নেই জানিয়ে গভর্নর বলেন, ‘রমজান মাস সামনে রেখে পর্যাপ্ত ডলার মজুদ রয়েছে এবং এরই মধ্যে গত বছরের তুলনায় ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি এলসি খোলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, পাঁচ ব্যাংক একীভূত করে ৩৫ হাজার কোটি টাকা মূলধনসহ একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠন করা হবে, যা ব্যাংকিং খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা কাটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. এ কে এনামুল হক বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বর্তমানে ‘চোর ধরা’ মনোভাব দ্বারা পরিচালিত, যা বিনিয়োগ পরিবেশে আস্থার সংকট তৈরি করে। অর্থনীতি যদি আস্থাহীন পরিবেশে চলে, তাহলে ব্যবসা, শিল্প বা নতুন বিনিয়োগ- কোনোটিই আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোতে পারে না।
তিনি বলেন, দেশজুড়ে অসংখ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলেও তাদের কার্যক্রমে দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি নেই। করব্যবস্থাকে তিনি ‘জমিদারি মানসিকতা’ উল্লেখ করে বলেন, এখানে মূল লক্ষ্য উন্নয়ন নয়, বরং কর আদায়ই প্রধান উদ্দেশ্য। এ ধরনের মানসিকতা বিনিয়োগ ও উৎপাদন উভয় খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তার মতে, অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে করব্যবস্থায় সংস্কার, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং জনগণ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
হা-মীম গ্রুপের এমডি এ কে আজাদ বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চাপের মধ্যে আছে। কঠোর মুদ্রানীতির কারণে ব্যাংক সুদের হার বেড়েছে, ফলে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। প্রাইভেট সেক্টরে মাত্র ৬ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি আছে, যা দেশের শিল্পায়নকে স্থবির করে দিয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, নানা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। তাঁর মতে, সরকারকে শিল্প খাতকে সচল করতে স্থিতিশীল নীতি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং সহায়তা ও কম সুদের ঋণ ছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কঠিন। তিনি বলেন, স্থানীয় উৎপাদনশীল খাতকে রক্ষায় সরকারকে অবিলম্বে নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে।
বিএসএমএ সভাপতি ও জিপিএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বর্তমানে দেশের স্টিল ও সিমেন্ট শিল্প সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় পার করছে। কভিড-পরবর্তী বৈশ্বিক সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, ডলার সংকট ও অস্বাভাবিক মুদ্রা অবমূল্যায়নের ফলে খাতটি মারাত্মক চাপের মুখে। এলসি খোলার জটিলতা এবং ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ব্যয় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান পূর্ণ সক্ষমতায় কারখানা চালাতে পারছে না।
তিনি জানান, সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ; নতুন কোনো ফ্যাক্টরি সম্প্রসারণ বা নির্মাণ হচ্ছে না। ফলে স্টিল-সিমেন্ট খাত লোকসান গুনছে। তিনি সমালোচনা করে বলেন, লোকসানে থাকলেও ব্যবসায়ীদের টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হয়, যা বিশ্বের অন্য কোথাও নেই। এ ছাড়া নীতি সুদের হার কমাতে তিনি গভর্নরের প্রতি জোর দাবি জানান।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবি চেয়ারম্যান মাসরুর আরেফিন বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে এখন আগের তুলনায় সুশাসন ফিরে আসছে। আগে বোর্ডরুমে বসে প্রভাবশালী গ্রাহকরা ঋণ পেতেন, কিন্তু এখন তা নিয়মের বাইরে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে ডিসিপ্লিন তৈরি হওয়ায় ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আসবে, তবে সময় লাগবে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম থাকলেও এটি সাময়িক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে বিনিয়োগ বাড়বে এবং বেসরকারি খাত শক্তিশালী হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ব্যাংকিং সেবা প্রান্তিক পর্যায়ে সম্প্রসারণ না করলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। ডিজিটাল লেনদেন, ওপেন ওয়ালেট এবং উদ্ভাবনী আর্থিক সেবার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছালে অর্থনীতির ভিত্তি আরো শক্ত হবে।

