কেন গাজার মাঝ বরাবর রাস্তা তৈরি করছে ইসরায়েল?

0

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজার মাঝ বরাবর একটি রাস্তার নির্মাণকাজ সবেমাত্র শেষ করেছে। রাস্তাটি গাজার পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে গেছে।

ইসরায়েল বলছে, পণ্য ও ত্রাণ সরবরাহের উদ্দেশ্যে এই রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এটা হয়তো একটা স্থায়ী অবকাঠামো হতে পারে।

নতুন রাস্তাটি নাহাল অজ কিবুৎজ এর কাছে ইসরায়েল-গাজার সীমান্ত প্রাচীর থেকে শুরু হয়েছে। এটি গাজার উপর দিয়ে গিয়ে পশ্চিমে উপকূলীয় এলাকায় গিয়ে শেষ হয়েছে।

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জ্যাকব নেগেল, যিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা, বলেন, নতুন কোনও হুমকি তৈরি হলে যাতে নিরাপত্তা বাহিনী দ্রুত প্রবেশ করতে পারে তার জন্যই এই রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।

কিন্তু অনেক বিশ্লেষক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, চলমান যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এই রাস্তাটি গাজায় রাখার ইসরায়েলি পরিকল্পনার অংশ হতে পারে।

নতুন রাস্তাটি গাজার উত্তরাঞ্চলের উপর দিয়ে চলে গেছে। গাজার মধ্য এবং দক্ষিণাংশ এর নিচের দিকে রয়েছে।

যদিও ছোট আরও অনেক রাস্তা রয়েছে যেগুলো গাজার পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলকে যুক্ত করেছে, তারপরও আইডিএফ এর তৈরি করা নতুন রাস্তাটি কোন ধরনের বাধা ছাড়াই গাজার উপর দিয়ে চলে গেছে।

এই রাস্তাটির সাথে সালাহ আল-দীন এবং আল-রশীদ সড়কেরও সংযোগ রয়েছে। এই দুটি রাস্তা গাজার সড়ক নেটওয়ার্কের মূল ধমনীর মতো কাজ করে।

গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধপরবর্তী গাজা নিয়ে তার ভিশন উন্মোচিত করেছেন যেখানে ইসরায়েল অনির্দিষ্টকালের জন্য গাজার নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করবে।

নতুন নির্মিত রাস্তাটি গাজা নিয়ে ইসরায়েলের যুদ্ধ পরবর্তী কৌশল নিয়ে আবারও বিতর্ক উস্কে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নতুন রাস্তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে আইডিএফ বলেছে, তারা ‘সামরিক বাহিনী পরিচালনার জন্য একটি সামরিক এলাকা (operational foothold)’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে যাতে সেনাদের চলাচল ও যন্ত্রপাতি পরিবহন সহজ করা যায়।

রাস্তা সম্পর্কে আরও কী জানা যাচ্ছে?

বিবিসির বিশ্লেষণ করা স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, এর আগে থাকা সংযোগহীন সড়কগুলো সংযুক্ত করতে আইডিএফ পাঁচ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা নতুন করে তৈরি করেছে।

ইসরায়েলি সীমান্তের কাছে গাজার পূর্বাঞ্চলে এই রাস্তাটির প্রথম অংশ নির্মাণ শুরু হয় গত অক্টোবরের শেষ এবং নভেম্বরের শুরুর মাঝামাঝি সময়ে।

কিন্তু নতুন রাস্তাটির বেশিরভাগ অংশই তৈরি করা হয়েছে ফেব্রুয়ারি এবং মার্চের প্রথমদিকে।

শুধু সালাহ আল-দীন সড়ক ছাড়া গাজার বাকি সব রাস্তার তুলনায় নতুন রাস্তাটি বেশ চওড়া।

ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাস্তাটির পাশে যেসব ভবন ছিল, যেগুলো গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হত, সেগুলো ডিসেম্বর মাসের শেষ থেকে শুরু করে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে বহুতল একটি ভবনও রয়েছে।

রাস্তাটি এমন একটি এলাকায় তৈরি করা হয়েছে যেদিকে এর আগে গাজার অন্যান্য অংশের তুলনায় কম ভবন এবং কম জনবসতি ছিল।

আইডিএফ পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলাচল করতে এর আগে যে রাস্তাটি ব্যবহার করতো, নতুন এই রাস্তাটি তার থেকে নিচের দিকে অবস্থিত।

গত ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এই রাস্তা সম্পর্কে খবর প্রচারিত হয় যেখানে এটিকে “হাইওয়ে ৭৪৯” নামে উল্লেখ করা হয়। চ্যানেল ফোরটিন এর একজন প্রতিবেদক ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে এই রাস্তাটির কিছু অংশ ঘুরে দেখেছেন।

ভিডিওতে রাস্তা তৈরিতে ব্যবহৃত যানবাহন এবং খনন কাজের যন্ত্রপাতি দেখা যায় যেগুলো রাস্তাটির নতুন অংশের নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

সম্ভাব্য ব্যবহার কী হবে?

জেনস নামে একটি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা কোম্পানির বিশ্লেষকরা বলেন, চ্যানেল ফোরটিনের ভিডিওতে যে কাঁচা রাস্তা দেখা যাচ্ছে সেগুলো সাঁজোয়া যান চলাচলের জন্য উপযুক্ত।

আইডিএফ যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে এ সম্পর্কিত বিস্তারিত কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি। এতে বলা হয়েছে, “স্থল অভিযানের অংশ হিসেবে, আইডিএফ অভিযানের স্বার্থে যাতায়াতের জন্য একটি রাস্তা ব্যবহার করছে।”

ইসরায়েলের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাবেক প্রধান জেনারেল জ্যাকব নেগেল রাস্তাটির নিরাপত্তার উপর জোর দেন।

তিনি বলেন, “এর মাধ্যমে ইসরায়েলের জন্য ভেতরে প্রবেশ এবং বের হতে সুবিধা হবে… কারণ গাজার পূর্ণ প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা এবং সব ধরনের দায়িত্ব থাকবে ইসরায়েলের হাতে।”

তিনি একে “গাজার উত্তরাঞ্চলকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্নকারী রাস্তা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

আইডিএফ এর সাবেক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ইয়াকভ আমিদ্ররও একটি মত দিয়েছেন।

তিনি বলেন, নতুন রাস্তার প্রথম উদ্দেশ্য হবে ওই এলাকায় কৌশলগত এবং সামরিক নিয়ন্ত্রণ সহজতর করা।

সাবেক ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা জাস্টিন ক্রাম্প যিনি সিবিলাইন নামে একটি রিস্ক ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি পরিচালনা করেন, তিনি এই রাস্তাটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।

ক্রাম্প বলেন, “অবশ্যই দেখে মনে হচ্ছে যে গাজা উপত্যকায় অন্তত কিছু নিরাপত্তা হস্তক্ষেপ এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য এটা দীর্ঘ মেয়াদি কোনও কৌশলের অংশ।”

“এই এলাকা গাজা শহরটিকে উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চল থেকে পৃথক করে ফেলছে, যা একে একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করছে যার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। একই সাথে গুলি ছোড়ার জন্য তুলনামূলক খোলা এলাকাও তৈরি করেছে।”

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো খালিদ এলগিন্ডিও মনে করেন এই রাস্তাটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অংশ।

“মনে হচ্ছে যে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী অনির্দিষ্ট সময় ধরে গাজায় অবস্থান করবে,” এলগিন্ডি বলেন।

এই ইন্সটিটিউটে তিনি ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি সম্পর্ক বিষয় কর্মসূচির পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এই বিশ্লেষক বলেন, “গাজাকে অর্ধেকে ভাগ করার মানে হচ্ছে ইসরায়েল শুধু গাজায় প্রবেশ ও বের হওয়ার উপরই নিয়ন্ত্রণ পাচ্ছে না, বরং গাজার অভ্যন্তরীণ চলাচলের উপরও তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে।”

“এর অংশ হতে পারে গাজার দক্ষিণে আশ্রয় নেওয়া ১৫ লাখ ফিলিস্তিনিকে উত্তরাঞ্চলে তাদের বাড়ি-ঘরে ফিরতে না দেওয়া।” সূত্র: বিবিসি বাংলা, সিএনএন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here