কৃষকের গল্পে কোর্টরুম ড্রামা, অক্ষয়-আরশাদকে ছাপিয়ে হিরো সৌরভ শুক্লা

0
কৃষকের গল্পে কোর্টরুম ড্রামা, অক্ষয়-আরশাদকে ছাপিয়ে হিরো সৌরভ শুক্লা

ভারতের সাম্প্রতিক সিনেমাগুলোতে সামাজিক বাস্তবতা, কোর্টরুম ড্রামা আর ব্যঙ্গাত্মক রাজনৈতিক স্যাটায়ার, এই তিনের মিলন দেখা যায় না বললেই চলে। ঠিক এ শূন্যতাটাই পূরণ করেছিল জলি এলএলবি ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম দুইটি ছবি। আর ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে দর্শকের প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া।

সেই প্রত্যাশার চাপ মাথায় নিয়েই পরিচালক সুভাস কাপুর তৈরি করেছেন জলি এলএলবি ৩। যেখানে কোর্টরুমের হাস্যরস, সিস্টেমের কঠিন দিন বা বাস্তবতা, আর কৃষকের নীরব আর্তনাদ একত্রে মিশে গেছে।

সিনেমার সব শেষ চিত্রে পরিচালক আমাদের নিয়ে যায় মুভিটির মূল মেসেজ অর্থাৎ কৃষকদের প্রতি এক নীরব সম্মান জানাতে। প্রতিবার খাবার মুখে তোলার আগে যে কৃষকের শ্রম, ঘাম আর আত্মত্যাগ লুকিয়ে থাকে। মুভিটি সেই কথাটাকেই বারবার মনে করিয়ে দেয়।

মূল গল্প ঘুরে দাঁড়ায় কৃষকের দুর্দশা, অর্থের অনিশ্চয়তা, আত্মহত্যার প্রবণতা এবং বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানির শোষণকে ঘিরে। সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলোকে পরিচালক কখনও অতিরঞ্জিত করেননি। বরং ব্যঙ্গ, হাস্যরস আর সংবেদনশীলতার মিশেলে তুলে ধরেছেন এক মানবিক বাস্তবতা।

জলি এলএলবি ১ ও ২ এর জনপ্রিয়তার পর এই ফ্র্যাঞ্চাইজির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, অক্ষয় কুমার ও আরশাদ ওয়ারসিকে একসঙ্গে পর্দায় দাঁড় করিয়ে তাদের দুজনকেই যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া। দর্শকের ভয় ছিল, অক্ষয়ের স্টারডম যেন আরশাদের বাস্তবসম্মত অভিনয়কে ঢেকে না দেয়। কিন্তু সিনেমাটি সেই ভয়কে মুছে দেয় প্রথম ঘণ্টার মধ্যেই। দুজনই সমান গুরুত্ব পেয়েছেন, দুজনের চরিত্রই গল্পকে সামনে নিয়ে গেছে, আর দুজনের মুখোমুখি বাক্যালাপ সিনেমার সবচেয়ে এন্টারটেইনিং মুহূর্তগুলো তৈরি করেছে।

তবে এই ফিল্মের প্রকৃত নায়ক কে? এ প্রশ্নের উত্তর একবাক্যে বলা যায়, জজ সুন্দর লাল ত্রিপাঠী, অর্থাৎ সৌরভ শুক্লা। তার উপস্থিতি বরাবরের মতোই শক্তিশালী, কিন্তু এখানে তিনি একাই কোর্টরুমের প্রাণভোমরা। তার তীক্ষ্ণ সংলাপ, নিখুঁত কমেডিক টাইমিং এবং মাঝে মাঝে স্নিগ্ধ মানবিক মুহূর্ত। এই তিনেই সিনেমাটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। পরিচালক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার চরিত্রে একটি ছোট প্রেমের উপকথা যোগ করেছেন, যা মূল কাহিনীকে পরিবর্তন না করলেও কৌতুকধর্মী রিলিফ হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর।

অভিনয়
অক্ষয় কুমার তার পরিচিত স্মার্ট, কৌতুকমিশ্রিত লড়াকু আইনজীবীর চরিত্রে যথেষ্ট প্রভাব রেখে গেছেন। আরশাদ ওয়ারসির প্রাকৃতিক অভিনয় এখানে আগের পর্বের মতোই সাবলীল, সংযত ও বাস্তবধর্মী। সিনেমার ভিলেন গুজরাত রাও চরিত্রটি গ্রে শেড এর। কিছুটা শক্ত, চরিত্রের প্রভাব এবং হুমকির আবহ দুটোই দর্শককে অনুভব করায়। নায়িকা যে দুইজন অর্থাৎ হুমা কোরেশী ও অমৃতা রাও, গল্পে খুব বেশি সময় না পেলেও তার অভিনয় গল্পটাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। । কৃষকের চরিত্রে অভিনয়শিল্পীরা অত্যন্ত ন্যাচারাল অভিনয় করেছেন, যা গল্পকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করেছে।

টেকনিক্যাল দিক
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী। বিশেষ করে কোর্টরুম দৃশ্যগুলোতে টেনশন তৈরি এবং সামাজিক বার্তাগুলোকে আন্ডারলাইন করতে সংগীত দারুণভাবে সাহায্য করেছে।

স্ক্রিনপ্লে ধারাবাহিকভাবে গল্পকে এগিয়ে নিলেও কিছু জায়গায় গতি কমে যায়, বিশেষ করে মাঝামাঝি অংশে যেখানে কিছু দৃশ্য অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। তবে হাস্যরসের বহু মুহূর্ত এবং সংলাপ বিনিময়ের ঝাঁজ সেই কমতিটুকু পুষিয়ে দেয়।

একটি জায়গায় পরিবর্তন হয়েছে। জলি এলএলবি ১ ও ২ এর মতো পূর্ণাঙ্গ কোর্টরুম ড্রামা এখানে নেই। গল্পের একটি বড় অংশ আদালতের বাইরের বাস্তবতাকে ধরে, যা দর্শকভেদে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।

গল্প ও বার্তা
ফসল ফলাতে কৃষকের জীবন-মরণ যুদ্ধ, আর এর থেকেও বড় যুদ্ধ হচ্ছে উন্নয়নের নামে নিজের নিজের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে ফেলার ভয়। এবং আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া নির্মম বাস্তবতা। মুভিটি অনেক সংবেদনশীল বিষয়কে ছুঁয়েছে। সরকারি ব্যবস্থার অবহেলাকে ব্যঙ্গাত্মক অথচ প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক। কোর্টরুমে অক্ষয়-আরশাদের যুক্তিতর্ক, এবং সৌরভ শুক্লার তীক্ষ্ণ মন্তব্য সমাজব্যবস্থার দুর্বলতাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে।

সব শেষে, সুভাস কাপুরের দিকনির্দেশনা সুনিয়ন্ত্রিত, পরিমিত এবং আবেগঘন। একটি সামাজিক বিষয়কে বিনোদনের মোড়কে উপস্থাপন করা মোটেও সহজ কাজ নয়। তিনি তা করেছেন যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে।

উপসংহার
জলি এলএলবি ৩ নিছক বিনোদন নয়। এটি সমাজের উপেক্ষিত মানুষের গল্প, কৃষকের জীবনকে সম্মান জানানোর এক কার্যকর চেষ্টা। কমেডি, ব্যঙ্গ, আবেগ, কোর্টরুম ড্রামা। সবকিছুর মিশেলে এটি আবারও প্রমাণ করে দেয় যে জলি এলএলবি শুধু একটি সিনেমা নয়, বরং সমাজের প্রতি নীরব প্রতিবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here